১.ভারতের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানে বৈষয়িক ও আদর্শগত পটভূমি আলোচনা কর।
উত্তর: ভারতের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের বৈষয়িক (পার্থিব) ও আদর্শগত পটভূমি নিচে আলোচনা করা হলো:
বৈষয়িক (পার্থিব) পটভূমি
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর সময় ভারতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এ সময় শহরের বিস্তার, কারিগর এবং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির প্রসার ঘটে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত বৃদ্ধি এবং নগর সভ্যতার বিকাশের ফলে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠিত হয়, যারা অনেক সময় ব্রাহ্মণ্যবাদের সনাতনী কুসংস্কার ও আচার-অনুষ্ঠান উপেক্ষা করতে শুরু করেন।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যাগ-যজ্ঞ, পশুবলি, এবং ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব ছিল যথেষ্ট। সাধারণ মানুষের দুর্দশা, ক্ষুদ্র কৃষকের আর্থিক সংকট, এবং অসহিষ্ণু সামাজিক পরিবর্তনে প্রতিবাদী ধর্মান্দোলনের সূচনা হয়.
এই সামাজিক বৈষম্য, অনাচার ও জটিল অনুশাসনের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতবাদ সহনীয় ও সহজ পন্থা প্রদর্শন করে, ফলে শহুরে ও গ্রামীণ জনগণের মধ্যে নতুন ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে.
আদর্শগত (দার্শনিক) পটভূমি
বৈদিক ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যবাদের নানা অনুশাসন, বহুবিধ দেবতা ও আচার-অনুষ্ঠান ছিল; তবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম তার বিপরীতে সহজ দর্শন, সততা, অহিংসা, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার বিরোধিতা - এগুলির ওপর গুরুত্ব দেয়।
মহাবীর (জৈন ধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর) ও গৌতম বুদ্ধ — উভয়েই ধর্মীয় অনুশাসনে আত্মা, পুনর্জন্ম, কর্ম, মোক্ষ ইত্যাদি প্রশ্নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেন। ত্যাগ, সংযম, সাধনা ও আত্মশুদ্ধির ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়.
বৌদ্ধ ধর্মে চারটি মহৎ সত্য ও অষ্টাঙ্গিক পথের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভই চূড়ান্ত লক্ষ্য. তেমনি, জৈন ধর্ম অহিংসা, সত্য, অপরিগ্রহ, ব্রত পালন, এবং আত্মসংযমের ওপর নির্ভর করে.
প্রথম থেকেই, উভয় ধর্মে ঈশ্বরবিশ্বাসের গুরুত্ব কম এবং ব্যক্তিগত সাধনার, অভ্যন্তরীণ শুদ্ধতা ও জাতিভেদমুক্ত এক মানবিক সমাজের কথা বলা হয়েছে।
সারাংশ
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের পেছনে প্রাচীন ভারতের ধর্মীয়-সামাজিক কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আর্থ-সামাজিক রূপান্তর, নগরায়ণ, এবং মানুষের আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা—এসবই বৈষয়িক ও আদর্শগত পটভূমির প্রধান বিষয়। তাদের দর্শন এবং জীবনপদ্ধতি সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, যার ফলে নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
২.অশোকের ধম্মের বৈশিষ্ট্য লেখ।
উত্তর: অশোকের ধম্মের বৈশিষ্ট্য
অশোকের ধম্ম কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম নয়; এটি ছিল এক নীতিনির্ভর সামাজিক ও নৈতিক আচরণবিধি, যার উদ্দেশ্য ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের পরিশুদ্ধি। এই ধম্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
অহিংসা: প্রাণী হত্যা এবং যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ, সকল জীবের প্রতি দয়া ও করুণা প্রদর্শন।
দয়া ও করুণা: জীবজগতের প্রতি সদয় আচরণ, পশুহত্যা থেকে বিরত থাকা।
দানবৃত্তি: দরিদ্র, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্রাহ্মণ-শ্রমণদের উদ্দেশ্যে দানের গুরুত্ব।
সত্য ও শুচিতা: সততা, সুচিন্তা ও চিন্তাশুদ্ধি বজায় রাখা।
সংযম ও মার্দব: কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা, রাগ— এই সমস্ত পাপপ্রবণতা থেকে মুক্ত হওয়া এবং সৌজন্য, নম্রতা প্রকাশ।
মাতা-পিতা, গুরু, বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা: পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের উন্নতি ও সম্মান প্রদর্শন।
অল্প ব্যয়, অল্প সঞ্চয়: স্বল্প ব্যয় ও সঞ্চয়ের নীতি গ্রহণ।
সমন্বিত ধর্মনিরপেক্ষতা: জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য কল্যাণকামী, সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের আহ্বান।
এই ধম্মে বৌদ্ধ ধর্মের মূল উপাদান যেমন অষ্টাঙ্গিক মার্গ, আর্য সত্য, নির্বাণ— এসবের উল্লেখ নেই; বরং এটি সামাজিক-নৈতিক আচার ও মানবিক গুণবণ্টনের সংমিশ্রণ, যা ধর্মের চেয়ে নীতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
সংক্ষেপে:
বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা
অহিংসা প্রাণী হত্যা ও যুদ্ধ নীতির বিরোধিতা
দয়া ও করুণা জীবজগতের প্রতি সদয় আচরণ
দান দানশীলতা ও সামাজিক কল্যাণ
সততা ও শুচিতা সত্য, সুচিন্তা, চিন্তাশুদ্ধি
সংযম ও মার্দব পাপপ্রবণতা থেকে মুক্তি, সৌজন্য
পারিবারিক শ্রদ্ধা মাতা-পিতা, গুরু, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা
সমাজকল্যাণ সমাজে ঐক্য, সহনশীলতা ও শান্তি বজায় রাখা
অশোকের ধম্মের এসব বৈশিষ্ট্য তাঁর রাজ্যজীবন, প্রশাসন ও প্রজাসেবায় প্রতিফলিত হয়েছে, যা আজও মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়ের নিদর্শন হিসাবে গণ্য।
৩.সাম্রাজ্য বিজেতা ও শাসক হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অবদান লেখ।
উত্তর: চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য: সাম্রাজ্য বিজেতা ও শাসক হিসেবে অবদান
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্রাট। তিনি ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চাণক্য (কৌটিল্য)-এর সহায়তায় মগধের নন্দবংশকে পরাজিত করে মৌর্য বংশ স্থাপন করেন।
তার নেতৃত্বে ভারতের পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত বিস্ময়কর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। কলিঙ্গ ও তামিল অঞ্চল বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
সাম্রাজ্য বিজয়ের মূল কাজসমূহ
নন্দবংশের উচ্ছেদ: চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দূরদর্শী, বুদ্ধিমান ও সাহসী এক সেনানায়ক হিসেবে নন্দবংশকে উৎখাত করেন।
উত্তর-পশ্চিম থেকে গ্রীক ও ম্যাসিডনীয় শক্তি হটানো: আলেকজান্ডার মৃত্যুর পর সেলেউকোস নিক্যাটরকে পরাজিত করে পশ্চিমাঞ্চল দখল করেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে সেলিউকোসের কন্যাকে বিবাহ করেন ও ৫০০টি যুদ্ধহস্তী উপহার দেন।
দক্ষিণ অভিযানে সাফল্য: দাক্ষিণাত্য অঞ্চলেও মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান।
শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কৃতিত্ব
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চাণক্য (কৌটিল্য) রচিত অর্থশাস্ত্রের সাহায্যে একটি সুসংহত কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সংগঠিত সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন — প্রায় ৪ লক্ষ সৈন্যের শক্তিশালী বাহিনী ছিল তার।
আইন, গুপ্তচর, রাজকার্যে কেন্দ্রিকতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কৃষি ও শিল্পোন্নয়নে মনোযোগ দেন।
প্রজাদের কল্যাণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন; জনগণকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন।
শিল্পকলা ও স্থাপত্যে মৌর্য দরবারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
তিনি প্রথম শাসক, যিনি একক ছত্রচ্ছায়ায় বৃহত্তর ভারতবর্ষ একত্রিত করতে সক্ষম হন; এর আগের কোনো শাসক এত বিস্তার ও ঐক্য আনতে পারেননি।
তার নেতৃত্বে ভারতীয় জাতিগত ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে উঠে, যা পরবর্তীকালে অশোক সহ মৌর্য বংশকে আরও প্রসারিত করে।
সংক্ষেপে:
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাহস, কূটনীতি ও সংগঠনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে দক্ষ প্রশাসন, সাম্রাজ্য বিস্তার, বহিরাগতদের উৎখাত এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন তার প্রধান অবদান। এসব কীর্তির জন্যই তিনি ভারতীয় ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রকৃত সাম্রাজ্য বিজেতা ও শাসক হিসেবে স্মরণীয়।
৪.গুপ্ত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর: গুপ্ত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে
গুপ্ত সাম্রাজ্য (প্রায় ৩২০ থেকে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতবর্ষে একটি শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের শাসনব্যবস্থাকে নিচে সহজ ভাষায় সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
১. রাজতান্ত্রিক শাসন
গুপ্ত রাজারা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধিকারী ছিলেন। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ নির্বাহী, বিচারক ও সামরিক প্রধান।
রাজা নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, যুদ্ধ পরিচালনা এবং প্রধান কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা রাখতেন।
রাজা “পরমেশ্বর”, “পরমভট্টারক” ইত্যাদি উপাধি ধারণ করতেন, যার মাধ্যমে তার দেবত্ব এবং চরম কর্তৃত্ব প্রতিফলিত হতো।
২. মন্ত্রিসভা ও কর্মকর্তাগণ
রাজার পরামর্শদাতা ছিলেন মন্ত্রিসভা—যেখানে মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগ দেখভাল করতেন যেমন : রাজস্ব, বিচার, যুদ্ধ, ইত্যাদি।
প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন: প্রধানমন্ত্রী (মনত্রিমুখ্য), সামরিক প্রধান (সেনাপতি), রাজস্বকর্তা (অক্ষপাতালিক), পুলিশ প্রধান (দন্ডপাণি), প্রধান বিচারপতি (মহানন্দনায়ক) ইত্যাদি।
মন্ত্রিদের নিয়োগ ও বরখাস্তের চূড়ান্ত ক্ষমতা রাজার হাতে থাকত।
৩. প্রশাসনিক বিভাজন
সাম্রাজ্যটি ছিল বিভাগীয়, যেমন: ভুক্তি/দেশ/প্রদেশ (Bhukti), জেলা (Vishaya), মন্ডল, ভিথি, গ্রাম ইত্যাদি স্তরে বিভক্ত।
প্রতিটি বিভাগে সরকার নিযুক্ত উপারিকা/গভর্নর এবং জেলা পর্যায়ে বিশয়পাতি কার্য পরিচালনা করতেন।
গ্রামীণ স্তরে গ্রামপ্রধান (জন্মপতি/গ্রামাধ্যক্ষ) ও বুড়োরা (গ্রামবৃদ্ধ) স্থানীয় প্রশাসন, বিচার ও বিবাদ নিষ্পত্তি করতেন।
৪. বিচার ব্যবস্থা
রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক, তবে কেন্দ্রীয় আদালতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিচারকার্য করতেন।
গ্রামের স্তরে গ্রাম আদালত বা স্থানীয় সভা মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন হতো। ফা-হিয়েনের মতে শাস্তি ছিল সাধারণত নমনীয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধানও ছিল, যেমন মুদ্রারাক্ষস নাটক ও স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায়।
৫. কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসন
কেন্দ্রে শক্তিশালী মন্ত্রিত্ব ও আধিকারিকদের সমন্বয়ে প্রশাসন চলত।
প্রদেশে রাজা কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর প্রশাসন দেখভাল করতেন।
জেলা, শহর, গ্রাম—হোলাস্বল্প সরকারী ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।
শহরের প্রশাসনে বাণিজ্যিক গিল্ড (Nagarseth) ও পেশাজীবীদের ভূমিকা ছিল বিশিষ্ট।
৬. গুপ্তচর/গোপন নজরদারি
প্রশাসনের কার্যকারিতা সুসংগঠিত রাখতে গুপ্তচর/আন্ডারকভার এজেন্টদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
৭. আয়-ব্যয় ও কর
প্রশাসনের মূল আয়ের উৎস ছিল ভূমি-কর। রাজস্ব সংগ্রহে দক্ষ কর্মকর্তারা নিয়োজিত থাকতেন।
কখনো রাজ্য পর্যায়ে কয়লা, লবণ, খনিজ ইত্যাদির কর ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সম্পদ সুরাহা করা হতো।
৮. বিকেন্দ্রীকরণ
গুপ্ত শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বশাসন। স্থানীয় রাজা, সমাজগোষ্ঠী, বণিক গিল্ড স্বয়ংক্রিয়ও স্বায়ত্তশাসিত ছিল, তবে কেন্দ্রীয় রাজার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল।
সংক্ষেপে:
গুপ্তদের শাসনব্যবস্থা একটি গৌণ-ভিত্তিক কিন্তু কেন্দ্রীয় শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্রশাসন। এখানে রাজা সর্বোচ্চ অথরিটি, মন্ত্রিগণ, গভর্নর, ও স্থানীয় প্রধানের সমন্বয়ে বিভিন্ন স্তর কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্তের যুগে কার্যকর ছিল, যার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য—বিকেন্দ্রীকরণ, ভালো সংগঠিত বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, এবং গুপ্তচর কার্যকলাপ যা সমগ্র সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
৫.গুপ্ত যুগকে কি সুবর্ণ যুগ বলা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা যায়। কারণ এই সময়টিকে ভারতের ইতিহাসে “Golden Age” বা সুবর্ণ যুগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বহু গবেষক ও ঐতিহাসিকের মতে। গুপ্ত যুগ (প্রায় ৩২০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) ছিল শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতির সময়।
কেন গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয়
শিল্প ও স্থাপত্য: এই সময়ে অজন্তা ও ইলোরার গুহাচিত্র, বিখ্যাত মূর্তিশিল্প, মন্দির নির্মাণ এবং মহান স্থাপত্যশৈলী গড়ে ওঠে।
সাহিত্য: কালিদাস, হরিসেন, বিশাখদত্ত, শুদ্রক, আমরসিংহ প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকরা গুপ্ত যুগে কাজ করেছেন; সংস্কৃত সাহিত্য, নাটক ও মহাকাব্য সমৃদ্ধ হয়েছে।
বিজ্ঞান ও গণিত: আর্যভট্ট, বরাহমিহির, চরক, সুশ্রুত প্রমুখ বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক এই সময়ে উপযোগী অবদান রেখেছেন। এই যুগেই দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির আবিষ্কার হয়।
অর্থনীতি ও সমাজ: বিস্তৃত রাজনৈতিক ঐক্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং তুলনামূলক সামাজিক স্থিতিশীলতা ছিল।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা: হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের চর্চা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল গুপ্ত যুগে অত্যন্ত মূল্যবান।
কিছু ঐতিহাসিক বিতর্ক
তবে সকল ঐতিহাসিক এই “সুবর্ণ যুগ”-এর ধারণা সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে, কিছু সামাজিক বৈষম্য বা সমস্যাও ছিল, যেমন—নারীদের অবস্থান, বর্ণভেদের জটিলতা ইত্যাদি.
উপসংহার:
গুপ্ত যুগ—শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ‘সুবর্ণ যুগ’ হিসেবে গণ্য হয়।
৬.শাসক ও সাম্রাজ্য স্রষ্টা হিসেবে সমুদ্রগুপ্তের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর: সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের একজন মহাপ্রতিভাশালী শাসক এবং সাম্রাজ্য স্রষ্টা হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত। তার শাসনকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩৩৫ থেকে ৩৮০ সাল পর্যন্ত ছিল। সমুদ্রগুপ্ত শুধু রাজ্য জয় করেননি, তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে একটি বৃহৎ ও সুবিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সমুদ্রগুপ্তের শাসক এবং সাম্রাজ্য স্রষ্টা হিসেবে ভূমিকার প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:
সমগ্র উত্তর ভারতকে নিজের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আনেন এবং দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চল পর্যন্ত বহু রাজ্যকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন। সিংহলের রাজাও তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেছিল।
তার সভাকবি হরিষেণের রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে তার সামরিক জয় এবং রাজত্বকালের নানা তথ্য জানা যায়। তিনি দিগ্বিজয় নীতির মাধ্যমে দাাক্ষিণাত্যের ১২টি রাজাকে পরাজিত হলেও সরাসরি দখল না করে করদান ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়েছেন।
সামরিক কৌশল ও দূরদর্শিতায় সমৃদ্ধ ছিলেন; তার শত্রু রাজ্য থেকে রাজ্য বিজয় করা ছাড়াও কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা এবং রাজ্যকে সুসংগঠিত শাসন ব্যবস্থা উপহার দিয়েছেন।
বিভিন্ন রাজ্যকে চার শ্রেণীতে ভাগ করে শাসন করেছেন—কিছু রাজ্য সরাসরি তার শাসনে ছিল, কিছু রাজা করদাতা ছিল, আর কিছু আংশিক বা অর্ধস্বাধীন ছিল।
তার শাসন ব্যবস্থায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বিরাট ছিল। নিজে শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন, কিন্তু বৌদ্ধ এবং অন্য ধর্মের পণ্ডিতদের সম্মান জানাতেন।
শিল্প, সংস্কৃতি, সংগীত ও সাহিত্যকেও সমর্থন প্রদান করে তিনি একটি সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেন।
তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করে তার সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের প্রমাণ দিয়েছিলেন এবং ইতিহাসে তাকে "ভারতের নেপোলিয়ন" নামে অভিহিত করা হয় তার সফল সামরিক অভিযানের কারণে।
তার সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো অত্যন্ত কুশল এবং শক্তিশালী ছিল, যা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল।
সারসংক্ষেপে, সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন উজ্জ্বল সামরিক যোদ্ধা, সুচিন্তিত কূটনীতিবিদ এবং সফল শাসক, যিনি ভারতকে একটি কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেছেন। তার দীর্ঘ শাসনকালে অর্জিত বিজয় এবং সুশাসন ভারতীয় ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিল। এই কারণে তাকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ও সমগ্র ভারতের একজন মহান সাম্রাজ্য স্রষ্টা বলে বিবেচনা করা হয়।
১.ষোড়শ মহাজনপদ !
উত্তর: ষোড়শ মহাজনপদ (16 Mahajanapadas) প্রাচীন ভারতের ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক খ্রিস্টপূর্বে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত বিশাল আঞ্চলিক রাজ্য বা সাম্রাজ্যের নাম। "মহাজনপদ" শব্দটির অর্থ "বিশাল জনপদ বা বৃহৎ ভূমি"। মহাজনপদগুলি ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র (গণরাজ্য) এবং রাজতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থা ছিল।
ষোড়শ মহাজনপদ মোট ১৬টি ছিল, যেগুলি ছিল শক্তিশালী রাজ্যসমূহ, যেমন কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, অবন্তী, গান্ধার, বৃজি (বাজ্জি), মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, সূরসেন, অস্মক এবং কম্বোজ। এদের রাজধানী ও বর্তমান ভূখণ্ডও বিভিন্ন। যেমন কাশীর রাজধানী বারাণসী, কোশলের শ্রাবস্তী, গান্ধারের তক্ষশীলা, মল্লের কুশীনগর, মগধের পাটলিপুত্র ছিল.
এই মহাজনপদগুলোর মধ্যে বৃজি ও মল্ল ছিল গণরাজ্য (প্রজাতন্ত্র), বাকিরা ছিল রাজতন্ত্র দ্বারা শাসিত। এসব রাজ্যের মধ্যে ধর্মীয় প্রচার যেমন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রসার ঘটেছিল এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই, সংস্কৃতি বিকাশ ও সাম্রাজ্য গঠনের ইতিহাস সংঘটিত হয়েছিল। অবশেষে মগধ মহাজনপদ অন্যান্য রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে ভারতের প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে.
ষোড়শ মহাজনপদগুলি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর বিকাশ এবং ঐতিহাসিক ঐক্যের সূচনা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে মগধ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য যা মৌর্য সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিল.
সংক্ষেপে, ষোড়শ মহাজনপদ ছিল প্রাচীন ভারতের ষষ্ঠ শতকের আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত ১৬টি প্রাচীন বৃহৎ রাজ্য বা প্রজাতন্ত্র, যারা পরবর্তীতে ভারতের সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি গঠন করে।
আপনি যদি গণরাজ্য ও রাজতন্ত্রের তুলনা বা প্রতিটি মহাজনপদের বিস্তারিত ইতিহাস জানতে চান, আমি তা আরও বিস্তারিত বলতে পারি।
২.মেগাস্থিনিস !
উত্তর: মেগাস্থিনিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, কূটনীতিবিদ এবং অনুসন্ধানকারী, যিনি হেলেনিস্টিক যুগে ভারতের সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি সিরিয়ার রাজা সেলিউকাস ১-এর রাজকীয় দূত হিসেবে ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন পাটালিপুত্র ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী। মেগাস্থিনিস ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশেপাশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে মারা যান বলে ধারণা করা হয়।
তিনি ভারত ভ্রমণ করে তার অভিজ্ঞতা ও তথ্যগুলো 'ইন্ডিকা' নামক একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন, যা এখন হারিয়ে গেছে কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতি থেকে এর কিছু অংশ জানা যায়। 'ইন্ডিকা' তে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা, সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, নগরসমূহের সৌন্দর্যবৃদ্ধি এবং জনজীবনের নানা দিকের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। মেগাস্থিনিস ভারতের প্রায় ১১৮টি জাতির কথা উল্লেখ করেছেন এবং ভারতীয় সমাজের বিচিত্রতার চিত্র অংকন করেছেন।
তার ভারত ভ্রমণের সময় তিনি সিন্ধু নদীর পঞ্চনদ এলাকার বর্ণনা দিয়েছেন এবং পাটালিপুত্র পৌঁছেছেন। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে গঙ্গারিডি নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল, যা কঠোর সামরিক শক্তির কারণে আক্রমণাতীত ছিল।
মেগাস্থিনিসের দ্বারা প্রদত্ত তথ্য ও বর্ণনাগুলি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তৎকালীন ভারত সম্পর্কে অন্যান্য কোনও স্থায়ী ঐতিহাসিক দলিল বা প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই তাকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়।
৩.কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র !
উত্তর: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের একটি বিশিষ্ট ধারণামূলক গ্রন্থ, যা মূলত রাজনৈতিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রশাসন, যুদ্ধনীতি ও কূটনীতির একটি সমৃদ্ধ বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে। এটি মৌর্য যুগের সময় রচিত বলে বিশ্বাস করা হয় এবং কৌটিল্য (চাণক্য, বিষ্ণুগুপ্ত) এই গ্রন্থটির রচয়িতা। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি ১৫টি অধিকরণের মাধ্যমে গঠিত, যেখানে মোট প্রায় ১৫০টি অধ্যায় রয়েছে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যা থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো:
সরকারের প্রকৃতি, আইন-শৃঙ্খলা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত ব্যবস্থা
নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি, বাজার ও বাণিজ্য
মন্ত্রীদের কর্মপদ্ধতি ও উপদেশ গ্রহণের নিয়ম
কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধের তত্ত্ব
শান্তি ও যুদ্ধের নীতি, যুদ্ধ এড়িয়ে চলার কৌশল
রাজ্যের অর্থনীতি, কর ব্যবস্থা, কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ও খনি
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শাসক, মন্ত্রিবর্গ, জনপদ, দুর্গ ও কোষাগারের ভূমিকা
সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতা, নারীর অধিকার ও পারিবারিক জীবন
শাসনের গুরুত্ব ও রাজ্যের সার্বভৌমত্বের ধারণা
গুপ্তচর ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম
বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা
অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে কৌটিল্য দাবি করেন যে, রাষ্ট্র ছাড়া সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং শক্তিশালী শাসক ও সুশৃঙ্খল প্রশাসন থাকলেই দেশের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তিনি যুদ্ধকে অপ্রত্যাশিত ও ব্যয়বহুল হওয়ায় যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তির পথ অনুসরণের পরামর্শ দেন, তবে প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী ও যুদ্ধেরকৌশলও ব্যাখ্যা করেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার মহাগ্রন্থ ও পূর্ব যুগের প্লেটোদের "রিপাবলিক" বা ম্যাকিয়াভেলের "দ্যা প্রিন্স" এর সমতুল্য ধরা হয়। এটি রাজ্য পরিচালনা, শোষণ, উন্নতি ও কূটনীতি বিষয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত।
সারাংশে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র একটি বহুমাত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা যা রাজ্য ও সমাজের স্থিতি, উন্নতি ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম ও কৌশল উপস্থাপন করে.
৪.ত্রিপিটক !
উত্তর: ত্রিপিটক হলো বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম ও প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম। অর্থাৎ, এটি গৌতম বুদ্ধের ধর্ম, দর্শন, বাণী ও উপদেশসমূহের সমাহার। "ত্রিপিটক" শব্দের অর্থ "তিনটি পিটক" বা "তিনটি ঝুড়ি" যা মূলত তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত:
বিনয় পিটকঃ এটি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জন্য বিধি-নিয়মের সংগ্রহ, যা তাদের নৈতিক জীবন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করে।
সূত্র পিটকঃ এখানে বুদ্ধের শিক্ষা, ধর্মবিষয়ক বাণী ও উপদেশের সংকলন রয়েছে।
অভিধর্ম পিটকঃ এটি ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, মনস্তত্ত্ব ও অন্যান্য বিমূঢ় এবং গভীর বিষয় নিয়ে গঠিত।
ত্রিপিটকের গ্রন্থন খ্রিষ্টপূর্ব ৫শ থেকে ৩শ বছর পর্যন্ত সময়ে মৌখিকভাবে প্রচলিত থেকে পরে লিখিত রূপে রূপান্তরিত হয়। এটি মূলত পালি ভাষায় রচিত এবং থেরবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায় এই গ্রন্থকে স্বীকৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে। সম্রাট অশোকের শাসনামলে ত্রিপিটক গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক দিকগুলোকে ধারণ করে এবং এটি বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত.
সুতরাং, ত্রিপিটক হলো গৌতম বুদ্ধের ধর্মীয় শিক্ষা, শিষ্যদের জন্য নিয়ম-কানুন, এবং বৌদ্ধ দর্শনের গভীর ব্যাখ্যার সংকলন যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র ও মৌলিক গ্রন্থ।
৫.দণ্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা !
উত্তর: দণ্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা হল দুটি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায়বিচার সম্পর্কিত নীতি যা বিচার ব্যবস্থা এবং আইনের সমানতা ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
দণ্ড সমতা (Danda Samata): এর অর্থ হলো শাস্তির সমতা বা সমান শাস্তি। এটি ন্যায়বিচারের এমন একটি নীতি যা বলে যে একই ধরনের অপরাধ যারা করে, তাদের একই রকম শাস্তি দেওয়া উচিত। এখানে অপরাধীর সামাজিক মর্যাদা, সম্পদ বা ক্ষমতা কিছুই বিবেচ্য নয়। এই নীতি নিশ্চিত করে যে অপরাধীদের সঙ্গে বৈষম্য করা হবে না এবং বিচার ব্যবস্থা সবার জন্য সমান ও নিরপেক্ষ থাকবে।
ব্যবহার সমতা (Vyavahara Samata): এর অর্থ হলো বিচার ব্যবস্থায় এবং আইনি কার্যক্রমে সমান ব্যবহার। অর্থাৎ, সকল ব্যক্তিকে আইনগত প্রক্রিয়ায় সমান অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয়। এই নীতি লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য প্রতিহত করে এবং বিচার ব্যবস্থায় ন্যায্যতা ও সাম্যের নিশ্চয়তা দেয়।
এই দুই নীতিই আইনের অধীনে সমান ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সাহায্য করে। প্রাচীন ভারতীয় শাসক অশোকের শাসনকালে এই নীতিগুলো বিচার ব্যবস্থায় প্রণয়ন ও প্রচলন পায়, যা সকলের জন্য সমান আইনের শাসন নিশ্চিত করেছিল।
৬.বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ !
উত্তর: বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ (নিব্বানা) হলো সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক লক্ষ্য এবং মোক্ষলাভের চূড়ান্ত অবস্থা। এটি এমন এক অবস্থা যেখানে সকল আবেগ, তৃষ্ণা, আসক্তি ও দুঃখের নিঃশেষ ঘটে এবং ব্যক্তি পুনর্জন্ম ও জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পায়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল "নিভে যাওয়া" বা "বিলুপ্তি" যা মানসিক বন্ধন ও তৃষ্ণার অবসানকে নির্দেশ করে।
নির্বাণের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
এটি আবেগের নির্বাপন এবং মানসিক কার্যকলাপের অবসান।
জীবনের সমস্ত ব্যথা, দুঃখ, শোক, হতাশা ও অসন্তোষ থেকে মুক্তি।
জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তির অবস্থা।
অব্যক্ত, অনির্বচনীয় এবং সম্পূর্ণ শান্তিময় এক অবস্থা।
বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে নির্বাণ দুই প্রকার:
সোপাদিশেষ নির্বাণ: যেখানে দেহ ও মন (পঞ্চস্কন্ধ) অবশিষ্ট থাকে কিন্তু সমস্ত তৃষ্ণা নিস্তার পায়। এটি বুদ্ধের বোধি অবস্থার একটি পর্যায়।
অনুপাদিশেষ নির্বাণ: পঞ্চস্কন্ধের অবসান ঘটে এবং সম্পূর্ণ মোক্ষলাভ হয়, যা গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের অবস্থা।
নির্বাণের জন্য বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধ প্রতিপাদ্য করেছেন চারটি আর্য সত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণের মাধ্যমে মধ্যপন্থার পথ, যা কামনা ও আবেগ থেকে মুক্তির মাধ্যমে দুঃখের অবসান ঘটে এবং পরিত্রাণ লাভ হয়।
সারাংশে, নির্বাণ অর্থ জীবনের দুঃখ-তৃষ্ণার নিবারণ এবং সেই চরম শান্তি ও মুক্তির অবস্থা, যা অর্জিত হলে আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হয় না.
৭.বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ সংগীতি !
উত্তর: বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ সংগীতি বলতে বোঝায় বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে ভিক্ষুসঙ্ঘের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সভা বা সম্মেলনগুলিকে। গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তার শিক্ষা সংরক্ষণ, বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং ধর্ম-বিনয় সংক্রান্ত বিভিন্ন বিতর্ক মীমাংসার জন্য এই সংগীতিগুলি আয়োজন করা হয়েছিল। বৌদ্ধ সঙ্গীতির মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মৌখিকভাবে বুদ্ধের ধর্মোপদেশ সংকলন এবং প্রচার করতেন।
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ঠিক তিন মাস পরে বর্ষাকালের দ্বিতীয় মাসে রাজগৃহে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসের প্রথম পরিষদ, যেখানে বুদ্ধের শিক্ষা অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করা এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ করার জন্য আলোচনা হয়। এই সংগীতিতে গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য মহাকশ্যপ নেতৃত্ব দেন।
সংগীতিগুলি কয়েক মাস ধরে চলত এবং শত শত প্রবীণ ও জ্ঞানী ভিক্ষু এতে অংশগ্রহণ করতেন। বৌদ্ধধর্মের ধর্মোপদেশগুলি মৌখিক থেকে লিখিত আকারে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সঙ্গীতির বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বৌদ্ধ সংগীতির মাধ্যমে ধর্মের শিক্ষা বিশুদ্ধ ও সুসংহত রাখা হয় এবং বৌদ্ধ দর্শন, নীতি এবং আদর্শের সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া বৌদ্ধ সংগীতই বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস বুঝতে এক গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।
সাধারণভাবে, বৌদ্ধ সংগীতি বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘের ঐতিহাসিক বড় বড় পরিষদসমূহকে বোঝানো হয় যেগুলো বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার সংরক্ষণ, বিতর্ক নিষ্পত্তি ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
🌸 অবশ্যই সবাইকে শেয়ার করে। 👁️🗨️