বাল্মিকীর রামায়ণ ও কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে যে পার্থক্য বা স্বতন্ত্র্য রয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো।
উত্তর: বাল্মিকীর রামায়ণ ও কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে পার্থক্য
১. রচনার ভাষা ও কাল
বাল্মিকীর রামায়ণ: রচিত হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক।
২. মূল উদ্দেশ্য ও ভাবধারা
বাল্মিকীর রামায়ণ: এটি একটি মহাকাব্য; বীররস, ধর্ম, আদর্শ এবং মানবিক কর্মোদ্যোগের মহত্ত্বের বর্ণনা আছে। রাম এখানে দেবোপম পুরুষ।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: পাঁচালীর আকারে রচিত, এখানেই বাঙালি সমাজ, ভাবালুতা, বৈষ্ণবীয় ভক্তি এবং লৌকিক জীবনছায়া প্রবল। রামচন্দ্র এখানে দেবতার অবতার, সৃষ্টিকর্তারূপে প্রতিনিধি।
৩. চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
বাল্মিকীর রামায়ণ: মা সীতাকে বীরাঙ্গনা, স্বাধীনচেতা নারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। অপহরণের সময় তিনি রাবণের সঙ্গে দৃপ্ত তর্ক করেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: সীতাকে কোমল, ভীরু, সহনশীল নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অপহরণের সময় তিনি ভয়ে কাঁপেন।
৪. কাহিনির বিশুদ্ধতা ও সংযোজন
বাল্মিকীর রামায়ণ: মূল কাহিনি অনুযায়ী, তপস্বী বাল্মিকি তার আশ্রমে সীতাকে আশ্রয় দেন এবং উত্তরকাণ্ডে লব-কুশের জন্ম হয়, কিন্তু অনেক অলৌকিক বা নতুন গল্প নেই।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: এখানে মহীরাবণ-বধ, দুর্গাপূজার প্রসঙ্গ, অকালবোধনসহ অনেক বঙ্গীয় উপাদান যুক্ত হয়েছে, মূল সংস্কৃত কাহিনিতে নেই।
৫. ধর্মীয় ভাবধারা
বাল্মিকীর রামায়ণ: এখানে রাম মানব-আদর্শ, দেবত্ব নয়। তার কার্যকলাপে মানবিক দিক, ধর্মচিন্তা ও নৈতিকতা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: রাম বৈষ্ণব দেবতারূপে প্রতিষ্ঠিত। চরিত্রগুলি বঙ্গ সমাজের আলোকেই ব্যাখ্যা।
৬. সাহিত্যিক ও জনপ্রিয়তা
বাল্মিকীর রামায়ণ: ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম মহাকাব্য, বহু ভাষ্য ও অনুবাদে প্রসারিত।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: বাঙালি সমাজের অন্তরঙ্গ সাহিত্য, পাঁচালী আঙ্গিকে রচিত, গার্হস্থ্য জীবন ও ভাবালুতা প্রবল। এটি বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়।
৭. মৌলিকত্ব ও কল্পনার স্বাধীনতা
বাল্মিকীর রামায়ণ: ঐতিহাসিক-ধর্মীয় মূল কাহিনির অনুসরণ করেছে, অলংকার কম।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: আক্ষরিক অনুবাদ নয়, মৌলিক কল্পনা ও স্বাধীন সৃষ্টিশীলতা আছে। বিভিন্ন উপাখ্যান, দেশজ উপাদান এবং নতুন ঘটনা সংযোজিত।
উপসংহার
বাল্মিকীর রামায়ণ বিশুদ্ধ মহাকাব্যিক ঐতিহ্য রক্ষা করে, মানবিক আদর্শ স্থাপন করেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলার সংস্কৃতি, আবেগ ও সমাজজীবনের ছায়া নিয়ে বিশেষ সাহিত্যিক মর্মার্থ রচনা করেছে, যেখানে মূল কাহিনি অনুপ্রদান পেলেও দেশের মন ও মনন-ভাবের নির্যাস ফুটে উঠেছে।
কৃত্তিবাসের রচিত রামায়ণের বা শ্রী রাম পাঁচালী জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: কৃত্তিবাসের রচিত রামায়ণ বা শ্রী রাম পাঁচালীর জনপ্রিয়তার কারণ
কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ বা ‘শ্রী রাম পাঁচালী’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী কাব্য। তার জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ—
বাঙালি মানসিকতার প্রতিফলন: কৃত্তিবাস মূল সংস্কৃত রামায়ণকে হুবহু অনুবাদ করেননি; বরং স্থান ও কাল অনুগতভাবে নতুন কিছু গল্প, চরিত্র ও আবেগ সংযোজন করেছেন, যা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে। এতে বাঙালির ধর্ম, নৈতিক আদর্শ, পারিবারিক মূল্যবোধ ফুটে উঠেছে।
চরিত্রের বঙ্গীয়করণ: রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, হনুমান—এসব চরিত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণে হয়েছে বাঙালির আবেগ-সংবেদনা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রতীক। সীতার আত্মত্যাগ, রামের ভক্তি, লক্ষ্মণের কর্তব্যপরায়ণতা—এসবই বাঙালির নিজস্ব ভাবনা ও অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
স্থানীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ: রামায়ণে বাঙালি জীবনের প্রকৃতিগত উপাদান যেমন—বাংলার ফল, পাখি, গৃহকর্ম, উৎসব ও রীতিনীতি—প্রতিফলিত হয়েছে। দুর্গাপূজা, মা কালিকার পূজা প্রভৃতি কৃত্তিবাস তার রচনায় সংযোজন করেছেন, যা বঙ্গজ জনমানসে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
ভক্তি ও করুণরসের প্রাধান্য: কৃত্তিবাসীর রামায়ণে ভক্তিরস ও করুণরস প্রবল। এতে ভক্তবৎসল রাম, দুঃখিনী সীতা, ভ্রাতৃপ্রেম, দাস্যভক্তি—এসব আবেগ বাঙালি হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।
সহজ-সরল ভাষা ও ছন্দ: পরম সুললিত কথ্য বাংলায় ‘পয়ার’ ও ‘ত্রিপদী’ ছন্দে রচিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ সহজেই রসাস্বাদন করতে পারে। কৃত্তিবাসের পদসমূহ বহুদিন ধরে বাংলার লোকজীবনের অংশ হয়ে গেছে।
সর্বজনীনতা ও অসাম্প্রদায়িক আবেদন: ‘শ্রী রাম পাঁচালী’ শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত থাকেনি; এটি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়।
সারসংক্ষেপ
কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ বা ‘শ্রী রাম পাঁচালী’র জনপ্রিয়তা এসেছে স্থানীয় আবেগ, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ, সহজ ভাষা, চরিত্রের বঙ্গীয়করণ ও সর্বজনীন আবেদন থেকে। তাই যুগে যুগে এটি বাংলার হৃদয়জুড়ে স্থান পেয়েছে এবং বাঙালির জাতীয় মহাকাব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বীররস নায় কৃত্তিবাসী রামায়ণের মূল রস হল করুণ রস এই মতটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো।
উত্তর: কৃত্তিবাসী রামায়ণের মূল রস: করুণ রস—বিস্তারিত আলোচনা
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতিহীন এক অমূল্য কাব্য, যেখানে কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাঙালি সংস্কৃতি, অনুভূতি ও সমাজবোধকে প্রাণবন্তভাবে তুলে ধরেছেন। এই রামায়ণ মূলত ভাবানুবাদ, যেখানে কাব্যিক শিল্প ও লোকজ আবেগ প্রবলভাবে মিশে রয়েছে।
করুণ রস: প্রধান অঙ্গীরস
অনেক সাহিত্য বিশ্লেষকের মতে, কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রধান রস করুণ রস। এই মতের পক্ষে কয়েকটি মূল যুক্তি রয়েছে —
রাম-সীতা বিচ্ছেদ ও বেদনা: পুরা রামায়ণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাম-সীতা-বিচ্ছেদ, সীতা-হরণ, রামচন্দ্রের একাকীত্ব, সীতা-অগ্নি পরীক্ষা—এসবই হৃদয়বিদারক বেদনার চিত্রণ করে এবং করুণ রসকে উজ্জ্বল করে তোলে।
যুদ্ধজনিত বেদনা ও মৃত্যু: যুদ্ধ, ভাই-র আত্মত্যাগ, লক্ষ্মণের অজ্ঞান হওয়া, রাবণ ও কুম্ভকর্ণের পতন—এসব কাহিনীতে মর্মস্পর্শী বেদনার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
জনমানুষের সহজ-সমবেদনা: কৃত্তিবাসীর রামায়ণ বাংলার সাধারণ মানুষের আবেগ ও সহানুভূতিকে কেন্দ্রে রেখে রচিত। যুদ্ধ, বিরহ, বিচ্ছেদ—সবকিছুর মাঝে বাঙালি চরিত্রের করুণ অনুভূতির ছাপ দ্রুত উপলব্ধি করা যায়।
ভক্তিরস ও করুণার মেলবন্ধন: এখানে ভক্তি যেমন আছে, তেমনি বিচ্ছেদের, দুঃখের, এবং সহানুভূতির আবেগও প্রবল। রামায়ণের নায়ক, যেমন রাম, অনুগামীদের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া দেখিয়েছেন, যা করুণ রসকে আরও বেগবান করেছে।
বিরল রস বনাম করুণ রস
অনেকে দাবি করেন, রামচন্দ্রের যুদ্ধ, বীরত্বের দৃশ্য, হনুমানের কার্যকলাপ এবং রাবণ-বধ—এসব কৃত্তিবাসী রামায়ণে বীররসের উপস্থিতি জোরালো। তবে, প্রধান রস “করুণ রস” এই কারণেই, কারণ বিচ্ছেদ, বেদনা, আত্মত্যাগ, মানবিক মর্মবেদনা, এবং নায়ক-নায়িকার দুঃখ কাব্যজুড়ে মূল আবেগের ধারক।
সিদ্ধান্ত
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মূল রস ‘করুণ রস’—এই মতটি যথার্থ। কারণ এই কাব্যে স্বজনবিয়োগ, দুর্ভাগ্য, বেদনাবোধ, যুদ্ধের মধ্যবর্তী মৃত্যুভাব, ভক্তি ও মানবিক করুণার পরস্পর সংমিশ্রণ, কাব্যকে বাংলা সাধারণ জনমানুষের আবেগের ধারক করে তোলে।
“কৃত্তিবাসী রামায়ণ’-এর মূল অঙ্গী রস হল করুণ রস, কারণ এতে রাম-সীতা-বিচ্ছেদ, যুদ্ধজনিত বেদনা ইত্যাদি ব্যথার চিত্রণ পাওয়া যায়।”
সম্প্রসারিত বাংলা সংস্কৃতি ও মানুষের আবেগঘন করুণ অনুভূতি—এই কাব্যে বিশেষভাবে ফুটে ওঠে, যা একে যুগান্তকারী বাংলা মহাকাব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মৌলিকতা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: কৃত্তিবাসী রামায়ণের মৌলিকতা
কৃত্তিবাসী রামায়ণ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা মহাকাব্য, যার অনূদিত রূপ ও মৌলিকতা বাংলা সাহিত্যে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে।
১. ভাবানুবাদ ও মৌলিক সংযোজন
কৃত্তিবাসী রামায়ণ সরাসরি বাল্মীকি রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়; এটি মূলত ভাবানুবাদ। কবি কৃত্তিবাস ওঝা কেবল মূল কাহিনির রেখা অনুসরণ করেননি, বরং বহু নতুন গল্প, উপাদান, চরিত্র সংযোজন ও স্থানীয় রীতিনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতি একত্রিত করেছেন।
এ কাব্যে যেমন রামের 'অকালবোধন', বা রামের দুর্গাপূজার কথা এসেছে—যা বাল্মীকি রামায়ণে নেই—তেমনই বঙ্গীয় লোকবিশ্বাস, শাক্ত-ভক্তির ছাপ, বাংলার গ্রামীণ সমাজ, এবং বাঙালির আবেগ-রুচি দারুণভাবে মূর্ত হয়েছে।
২. বাংলার সামাজিক ও জীবনচিত্রের প্রতিফলন
রামের চরিত্র কৃত্তিবাস তার যুগের বাঙালির মূল্যবোধ, আবেগ, স্বাতন্ত্র্য ও লোকচেতনার আদলে গড়ে তুলেছেন। লক্ষ্মণকে যেমন দেখা যায় এক বাঙালি যুবক, সীতাকে কান্তকোমল বাঙালি গৃহবধূ হিসেবে, হনুমান-বিভীষণ-সুগ্রীবের সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, হাস্য ও কান্নার আন্তরিক ছায়া পড়েছে।
যার ফলে কাশী, কোশল, মগধ, বিদিশার পৌরাণিক চরিত্রগুলি ভেঙে এসে বাংলার ঘর-সংসারের কলেবরে নতুন প্রাণ ফিরে পায়।
৩. ভাষা ও ছন্দের মৌলিকত্ব
কাব্যটি পয়ার ছন্দ ও পাঁচালীর আকারে রচিত, সহজবোধ্য পদ্যের ব্যবহার করে ক্রমে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।
কৃত্তিবাসের অলংকার, ভাষাশৈলী, নাটকীয়তা, হাস্য-করুণ-রসের মেলবন্ধন, এবং উক্তি বাঙালি জাতির সংস্কার, কল্পনা, পরম্পরা ও চিত্তরীতিকে শিল্পগুণে ভাসিয়ে তোলে।
৪. শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবাদর্শের সম্মিলন
মূল রামায়ণে রাম দেবতা নন; তিনি আদর্শ বীর মাত্র। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রকে দেবতারূপে, ভক্তদরদী অবতার হিসেবে জাগতিক পারেন। শাক্ত-ভক্তির ছায়া, দুর্গাপূজা, রাবণের চণ্ডীপূজা—বাংলার ধর্মীয় অধিবাস-বৈচিত্র্যে কৃত্তিবাস রামায়ণ অনন্য।
৫. অন্যান্য মৌলিক অংশ
কৃত্তিবাসী রামায়ণে অঙ্গ রায়বাণ, তরণীসেন বধ, মহীরাবণ-অহীরাবণ, লব-কুশের যুদ্ধ—এ ধরনের বহু কাহিনিকেও মূল রামায়ণের বাইরে এসে মিলেছে।
সারাংশ:
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মৌলিকতা মূলত তার ভাবানুবাদে, বাংলার লোকজীবনের ছায়াপাত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানের সংযোজন, আকর্ষণীয় ভাষা ও রস-রীতি, এবং শাক্ত-ভৈষ্ণব ভাবাদর্শের সম্মিলনে। এর ফলে এটি শুধু রামায়ণ অনুবাদ নয়, বরং বাঙালি জাতির এক অনন্য মহাকাব্য—নিজস্ব জাতীয় সত্তা ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী অমর সাহিত্য।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাঙালি সমাজ চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাঙালি সমাজ চিত্র
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলা ভাষার প্রথম ও জনপ্রিয় রামায়ণ অনুবাদ, যেখানে কৃত্তিবাস ওঝা শুধু মূল বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনিকে বাংলায় উপস্থাপন করেননি, বরং এতে সমকালীন বাঙালি সমাজের রীতিনীতি, আবেগ, সংস্কার ও আদর্শের স্পষ্ট ছাপ রেখেছেন। নিচে তার ওপর আলোচনার মূল দিকগুলি তুলে ধরা হলো—
১. বঙ্গীয়করণ ও সমাজ জীবনের ছাপ
কৃত্তিবাসী রামায়ণ মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়; বরং এতে অনেক বৈশিষ্ট্যে বাঙালি সমাজের ছোঁয়া রয়েছে। কবি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি, লোকজ সংস্কৃতি, ঘরোয়া জীবনের অনুষঙ্গ বহুলভাবে আনুগত্য করেছেন। এজন্য, রামায়ণ বাঙালি পরিবারের নিজস্ব ঘরোয়া কাব্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, কৈকেয়ি, মন্থরা, বিভীষণ, রাবণ—তাঁদের চরিত্রে কৃত্তিবাস সময়ের বাঙালি সমাজের আবেগ ও গুণাবলির প্রতিচ্ছবি রেখেছেন। যেমন—লক্ষ্মণকে করা হয়েছে সমাজের এক তরুণের মতো, কৈকেয়ী-মন্থরা সেকালের স্বার্থসন্ধানী নারী, সীতা সর্বংসহা, কোমল, এবং রামের বিলাপে ফুটে ওঠে বাংলার প্রেমিক-পুরুষের করুণ কাতরতা।
২. ধর্ম, ভক্তি এবং শাক্ত-বৈষ্ণব ভাব
কৃত্তিবাসের রামের মধ্যে দেবত্ব এবং ভক্তির ছাপ প্রবল। এখানে রাম শুধু পুরুষোত্তম নন, বরং বৈষ্ণব মত, ভক্তির রস, এবং বাংলার শাক্ত ধর্মের মিশেল রয়েছে। রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা, অকালবোধন, রামের নাম সংকীর্তন—all মিলিয়ে বাঙালির লোকধর্ম, সমাজের ধর্মচেতনা প্রকাশ পেয়েছে; যা মূল সংস্কৃত রামায়ণে নেই।
৩. আবেগ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ
কৃত্তিবাসী রামায়ণে করুণ রস বা আবেগের ব্যাপকতা লক্ষ্যণীয়। দশরথের মৃত্যু, সীতাহরণ, অরণ্যযাত্রা, সীতার অগ্নিপরীক্ষা—সবখানেই বাঙালির আবেগময়, বেদনাকাতর, মর্মস্পর্শী মনোভাব ফুটে উঠেছে।
গৃহ, পরিবার, সতীত্ব, আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব, নারীত্ব, প্রেম—এসব বাঙালি সমাজের মূল মূল্যবোধের শিল্পরূপ কৃত্তিবাস দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন। এটি বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও চিন্তার ছাপ বহন করে।
৪. প্রকৃতি ও স্থানীয় জীবন
কৃত্তিবাসের বর্ণনায় স্থানীয় ফল, পাখি, বৃক্ষ, নদী, মাটি—সবই উপস্থিত। উদাহরণস্বরূপ, তার কাব্যে আম, কাঁঠাল, সব পাখি, গ্রামের জীবন, উৎসব—বাংলাদেশের বারমাসিয়া, লোকজ ঐতিহ্য স্পষ্ট।
৫. সমকালীন রাজনীতি, ধর্মীয় সংকট ও সংগ্রামে প্রতিফলন
কৃত্তিবাসী রামায়ণের রচনার সময় তুর্কি কর্তৃত্ব, রাজ-সংকট, ধর্মীয় অনিশ্চয়তা ছিল। এসব সংকটের মাঝে কৃত্তিবাস জাতীয় সংহতি, পৌরুষ, সামাজিক সাহসিকতা, সততা, ত্যাগ ও নারী-পুরুষের সম্মানবোধ—এসব গুণাবলিকে উৎসাহিত করেছেন, যা তৎকালীন বাঙালি সমাজের কার্যকর চিত্র।
সংক্ষেপে
কৃত্তিবাসী রামায়ণ শুধুমাত্র রামকাহিনির বঙ্গীয় অনুবাদ নয়, বরং এটি তৎকালীন বাঙালি সমাজ, ধর্মচেতনা, আবেগ-অনুভূতি, পারিবারিক মূল্যবোধের জীবনঘনিষ্ঠ দর্পণ—যার মধ্যে বাঙালির ঘরোয়া ধর্ম, লোকপ্রবণতা, শাক্ত-বৈষ্ণব ভাবনাবিশ্ব, সমাজ-সংকটের সম্মিলিত চিত্র উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনী সংক্ষিপ্তকারে বর্ণনা করো।
উত্তর: কৃত্তিবাসী রামায়ণ হল চতুর্দশ শতকের বাংলা কবি কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত রামায়ণের অনুবাদ ও সংস্করণ, যা মূল বাল্মীকি রামায়ণের সরল অনুবাদ নয়, বরং বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাবধারার সঙ্গে মিলিয়ে বঙ্গীয়করণ ও পরিবর্তনসহ উপস্থাপিত হয়েছে।
সংক্ষিপ্তভাবে কাহিনী-সংক্ষেপ:
কৃত্তিবাসী রামায়ণ রামচন্দ্রের জন্ম, আশ্রম জীবন, দণ্ডকারণ্যবাস, সীতার হারানো ও উদ্ধার, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ, রাবণের বধ, এবং রাম-সীতার পুনর্মিলনের কথা উপজীব্য করে রচিত।
এটি পাঁচালীর আকারে পয়ার ছন্দে রচিত, সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী এবং গানের মত পরিবেশনের জন্য উপযোগী।
কাহিনীতে বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক ঘটনার বাইরেও কিছু লোকজ উপাখ্যান ও বাঙালি রীতি-নীতি যুক্ত করা হয়েছে, যেমন দুর্গা পূজা, কালিকা পূজা ইত্যাদি, যা মূল সংস্কৃত রামায়ণে নেই।
চরিত্রগুলো বাঙালির জীবনধারার মতো দেখানো হয়েছে; যেমন রামকে প্রেমের দেবতা ও ভক্তিপূর্ণ রূপে, লক্ষ্মণকে বাঙালি ভাইয়ের মতো এবং সীতাকে বাঙালি গৃহিণীর মত পরিচিত করা হয়েছে।
যুদ্ধকেন্ড্রে রাবণের সঙ্গে রামের দ্বন্দ্ব উপলক্ষ্যে বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের প্রতিফলন পাওয়া যায়, যেমন রাম দুর্গা পূজা করেন যুদ্ধে জয়ের উদ্দেশ্যে, যা একধরনের আঞ্চলিক সংস্কার।
অর্থাৎ, কৃতি্বাসী রামায়ণ শুধু রামায়ণের বাংলা অনুবাদ নয়, এটি মধ্যযুগীয় বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতির প্রতিফলন ও বাঙালি মনের সঙ্গে রামায়ণ উপাখ্যানের অভিযোজন।
এই রামায়ণ বাংলা সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ কালগ্রন্থ, যা বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে রামের কাহিনী জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকান্ড বা যুদ্ধকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত লেখো।
উত্তর: কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালী হলো চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলায় কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক রচিত রামায়ণের বাংলা অনুবাদ এবং রূপান্তর। এটি মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণের সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদ নয়, বরং একটি ভাবানুবাদ এবং বঙ্গীয়করণ, যাতে বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা দিক মিশ্রিত হয়েছে। বিশেষ করে লঙ্কাকান্ড অর্থাৎ যুদ্ধকান্ডে কৃত্তিবাসী রামায়ণ ঐতিহ্যগত বাল্মীকি রামায়ণের থেকে অনেক পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য বহন করে।
লঙ্কাকান্ড বা যুদ্ধকান্ডের মূল অংশগুলো হল রাবণের লঙ্কায় সীতাকে মুক্ত করার জন্য রামের বাহিনী ও রাক্ষসদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া। এতে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙা, রাবণের অভিমানের প্রকাশ, হনুমানের লঙ্কা দাহ, মেঘনাদের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধ, ইন্দ্রজিতের মৃত্যু এবং অবশেষে রাবণের পরাভব ও মৃত্যুর ঘটনা বর্ণিত হয়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকান্ডের কিছু বিশেষ দিক হলো-
কৃত্তিবাস এখানে রামচন্দ্রকে এক নবরূপী বীর ও ভগবান হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন, যিনি শুধু ভক্তেরই নয়, বানরসেনারও সহানুভূতিশীল।
রাবণের চরিত্রে মাতৃক-শাক্ত ও বৈষ্ণব ঐতিহ্যের মিল রয়েছে, যেখানে তিনি কখনো বিলাপময়, কখনো হতাশাজনক অভিমানে আচ্ছন্ন। যেমন ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর পর রাবণের করুণ অভিমতের বিশেষ ব্যাখ্যা আছে।
যুদ্ধের বর্ণনা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেখানে বাঙালির ভক্তিমানসার ছোঁয়া স্পষ্ট। রাম-লক্ষ্মণের সৌহার্দ্য, সীতার লজ্জাবোধ, ও মিত্র সিংহাসনের পরিবেশ বাংলার সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী চিত্রায়িত হয়েছে।
রাবণের অগ্নিকাণ্ড ও হনুমানের লঙ্কা দাহের অংশেও কৃত্তিবাস নানান নতুন বর্ণনা ও আবেগপ্রবণতা যোগ করেছেন, যা মূল রামায়ণ থেকে আলাদা।
গল্পের মাঝে বৈষ্ণব ও শাক্ত ভাবধারার দ্বন্দ্ব ও সংশ্লিষ্ট আখ্যানও ঢুকিয়েছেন, যা কাব্যটিকে নানা রসে পরিপূর্ণ করে।
অতএব, কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকান্ড মূল রামায়ণের যুদ্ধকাহিনী হলেও এতে বাংলা সমাজের আঞ্চলিক ও ধার্মিক আবেগ, লোক জীবনের অনুষঙ্গ, এবং বিশেষ সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মেয়াদ বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। যুদ্ধের প্রচণ্ড পরিবেশকে করুণায় মাখানো হয়েছে, যা বাংলাভাষী পাঠকের কাছে বিশেষভাবে মধ্যমণি হয়ে ওঠে।
এই কাব্যের মাধ্যমে রামায়ণের লঙ্কাকান্ড কেবল যুদ্ধের বর্ণনা নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সৈনিক ও ধর্মীয় চেতনার সূক্ষ্ম নিবিড় চিত্রায়ন হিসেবে দাঁড়িয়েছে.
রামায়ণের আদি কান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ।
উত্তর: রামায়ণের আদি কান্ড (Adi Kanda) বা বাল কাণ্ড (Bala Kanda) হল রামায়ণের প্রথম খণ্ড যা প্রধানত রামের জন্ম, শৈশব ও বিবাহের বিবরণ। এটি মহর্ষি বাল্মীকি রচিত মহাকাব্য রামায়ণের প্রথম অধ্যায় যেখানে রামের জীবনের প্রাথমিক ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে।
রামের জন্মকথা এই অংশেই বলা হয়েছে। অযোধ্যার রাজা দশরথের তিন কন্যাসহ তিন রাণীর মধ্যে কৌশল্যা কন্যার বধূ হয়ে জন্ম নেন রাম। দীর্ঘদিন পুত্রহীন থাকার জন্য রাজা দশরথ পুত্রপ্রাপ্তির জন্য বিশেষ যজ্ঞ সারান। সেই যজ্ঞ থেকে রাজা ও রাণীদের মাঝে দেবতাদের অভিষেকপ্রসূত অন্ন গ্রহণের পর রামের জন্ম হয়। কাইকেরী কন্যার পুত্র ভারত এবং কৌশল্যা ও কাইকেরী দুজনের অভাবে বিভাজিত দুই রাণীর অন্ন ভাগাভাগি করে খাওয়ানোর কারণে সুমিত্রার জামী দুই জোড়া জমাণি নামে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন জন্মগ্রহণ করেন।
আদি কাণ্ডে রামের শৈশব ও শিক্ষা যজ্ঞ বিষ্ণুমিত্রের কাছ থেকে বিশেষ শিক্ষা ও অস্ত্রবিদ্যা অর্জন, পাশাপাশি সীতা রাজকন্যার সঙ্গে রাম এর বিবাহ অনুষ্ঠানেরও বর্ণনা আছে। রাম সীতার বিয়ের জন্য শিবের তীর বাঁধার গল্প এখানে আছে যা অনেক বড়ো ঘটনা হিসেবে গণ্য।
এই খণ্ডে রামের আদর্শ, ত্যাগ, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ধর্মের প্রতি আনুগত্যের আদর্শ গড়া হয়েছে যা মহাকাব্যের মূল মন্ত্র হিসেবে কাজ করে।
সুতরাং, রামায়ণের আদিকাণ্ড প্রধানত রামের জন্ম, বাল্যকাল, শিক্ষা এবং সীতার সঙ্গে বিবাহের পথভ্রষ্ট আগমনের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে যা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তি গড়ে তোলে।
এটি রামায়ণের জীবনের শুরু থেকে প্রথম বড়ো ঘটনার শুরু পর্যন্ত বিস্তৃত।
মুকুন্দ চক্রবর্তীর অভয়ামঙ্গল কাব্যের কালকেতুর চরিত্রটি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: মুকুন্দ চক্রবর্তীর অভয়ামঙ্গল কাব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কালকেতু। কালকেতু চরিত্রটি একটি সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে, যা প্রান্তিক জাতির জীবনযাত্রার আর প্রতিচ্ছবি। তিনি পূর্বজন্মে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরের রূপে ছিলেন। কাব্যে কালকেতুকে শাপভ্রষ্ট দেবপুত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যার মধ্যে পৌরাণিক শক্তি এবং বীর্যবত্তার মিশ্রণ রয়েছে। তবুও, তার চরিত্রে আদিম সমাজের বীরত্ব ও বর্বরতা স্পষ্ট দেখা যায়। কালকেতু শিক্ষাহীন, সংস্কারহীন, শারীরিক শক্তিতে সম্পূর্ণতা পাওয়া একটি আদিম ব্যাধ সমাজের প্রতিনিধি, যার জীবনে আছে এক ধরনের সরল প্রগতি এবং অনাড়ম্বর প্রীতি।
কাব্যে কালকেতুর জীবনধারা এমন এক সময়ের সমাজের প্রান্তিক জীবনচিত্র তুলে ধরে, যেখানে ভোজনের আভিজাত্য নয় বরং বর্বরতামূলক খাদ্যাভাস বিদ্যমান। কালকেতুর ভাষা সরল ও অন্তর্জাগতিক, যা তার দরিদ্র ব্যাধ জীবনের প্রকৃত অভ্যন্তরীণ প্রকাশ। দেবী চণ্ডীর কৃপায় কালকেতু ধনলাভ ও রাজা হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েও তার চরিত্রে স্বাভাবিকতার বদলে কিছু কৃত্রিমতা যুক্ত হয়। রাজা হিসেবে সে প্রজাকল্যাণের কথা ভাবলেও তার মানসিক ও বৌদ্ধিক উন্নতি গল্পের বাস্তবতা থেকে কিছুটা বিচ্যুত। কালকেতুর চরিত্রে সামাজিক শ্রেণি ও সংস্কারের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট, যেখানে পৌরাণিক দেবত্বের সাথে তার গ্রাম্য এবং বণিক সমাজের জীবন মিশে গেছে।
অতএব, কালকেতু চরিত্রটি মুকুন্দ চক্রবর্তীর বাস্তববাদী কবিত্বের নিদর্শন, যা প্রান্তিক জাতির জীবনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক দিককে তুলে ধরেছে। যদিও তার চরিত্রে সামঞ্জস্যের অভাব রয়েছে, তবুও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও মানবিক চিত্র প্রদান করে, যেখানে আদিম বর্বর জীবনের মধ্যে স্বাধীনতা, সহজতা ও মানুষের আনন্দের মৌলিকতা প্রতিফলিত হয়েছে।
মুকুন্দ চক্রবর্তী অভয়ামঙ্গল কাব্যের ফুল্লরার চরিত্রটি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: মুকুন্দ চক্রবর্তীর "অভয়ামঙ্গল" কাব্যের ফুল্লরা চরিত্রটি গার্হস্থ্য জীবনের এক典型 নারী রূপে ফুটে উঠেছে। ফুল্লরা কালকেতুর যোগ্য পত্নী, যিনি স্বামীর সেবা করাকে নিজের ধর্ম মনে করেন। তিনি স্বামীর প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সংসারের দায়িত্ব পালন করেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নারী। ফুল্লরা স্বামীর ব্যাধ ও শিকারের ক্লান্তিকালে তার সেবা করেন, যা তার গার্হস্থ্য কর্তব্যবোধ ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত।
কবিতায় ফুল্লরা দেবী চণ্ডিকার সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে গ্রামের গৃহবধূর ছবি হয়ে ওঠে। সে ব্যাখ্যা করে যে নারীর ধর্ম হলো স্বামীকে সন্তুষ্ট করা এবং তাকে সমর্থন দেয়া, এমনকি স্বামীর ত্রুটিও সহ্য করা। ফুল্লরা স্বামীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখায় এবং সংসারে স্বামীর প্রতি সমর্থন ও প্রেরণার মাধ্যমে একটি আদর্শ পত্নী ও গৃহিণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
চরিত্রগত দিক থেকে ফুল্লরা অত্যন্ত মানবিক, বাস্তবধর্মী এবং নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী। তিনি সংসারের সামান্য কষ্ট ও অভাব সত্ত্বেও দায়িত্বশীল ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ রয়েছেন। তার কথাবার্তায় পাওয়া যায় যে, তিনি স্বামীকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করার চেষ্টা করেন এবং সংসারের শান্তি বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ফুল্লরার চরিত্রে নারীশক্তির মহিমা, গৃহকর্ত্রীর কর্তব্যপরায়ণতা এবং নৈতিক দৃঢ়তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
সর্বোপরি, ফুল্লরা মুকুন্দ চক্রবর্তীর কবিতায় নারী চরিত্রের জীবন্ত ও বাস্তব অঙ্কন। তিনি সুলভ আচরণ, মানবিক আবেদন এবং স্বামীর প্রতি অনুরাগপূর্ণ শ্রদ্ধার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ নারী চরিত্র হিসেবে স্মরণীয় হয়েছেন। ফুল্লরা একদিকে স্বামীকে আদর্শভাবে সেবা করে গৃহস্থালীর পরিচর্যা করেন, অন্যদিকে তার মানসিক দৃঢ়তা ও সাহসিকতা কবিতার মূল শিক্ষাও বয়ে আনে। এই চরিত্রের মাধ্যমে মুকুন্দ চক্রবর্তী মধ্যযুগীয় বাংলার নারীর সংসারিক জীবন ও চরিত্ররূপায়ণকে সপ্রতিভভাবে তুলে ধরেছেন।
মুকুন্দ চক্রবর্তী অভয়া মঙ্গল কাব্যে মধ্যযুগীয় বা তৎকালীন সমাজ জীবনে যে ছবি ফুটে উঠেছে তা লেখ।
উত্তর: মুকুন্দ চক্রবর্তী এর "অভয়া মঙ্গল" কাব্যে মধ্যযুগীয় বা তৎকালীন সমাজ জীবনের একটি বাস্তবসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিত্র ফুটে উঠেছে। এই কাব্যে তিনি মূলত দরিদ্র শিকারী কল্লাকেতু ও ধনী বণিক ধনপতির জীবন কাহিনী তুলে ধরেছেন, যাদের স্ত্রীদের সংসারিক জীবন এবং তাঁদের বিপদ—সকল কিছুই মঙ্গল দেবী অভয়া বা চণ্ডীর রক্ষা ও সাহায্যে উত্তরণ লাভ করে। এই কাব্যের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জটিলতাগুলি স্পষ্ট হয়।
মুকুন্দরামের সমাজ জীবনের চিত্রায়ণে দেখা যায় তখনকার সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার দুঃখ-কষ্ট, তাদের শাসনের অবস্থা, দুর্ভিক্ষ, শোষণ ও সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা। তিনি শুধু উচ্চবর্গের নয়, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকথাও প্রকাশ করেছেন। কাব্যে কেবল ধর্মীয় মঙ্গলগান নয়, বরং সময়ের সাধারণ মানুষের বাস্তব চিত্র, সামাজিক দুঃখবেদনা, পরিবারিক ও পারিবারিক জীবন, শিল্প-বানিজ্য ও কৃষিজীবনের দিকগুলো সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, মুকুন্দরামের ভাষ্যে মধ্যযুগীয় সমাজের প্রথাগত কাঠামোর পাশাপাশি মুসলিম সমাজের বিদ্যমানতা ও মতবাদকেও স্পষ্ট করে দেখা যায়। তিনি তার কাব্যে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার কথা বর্ণনা করে করেছেন। তাঁর প্রকাশ থেকে বোঝা যায় সে সময়ের সমাজে লেনদেন, শিল্প, বাণিজ্য, কারুশিল্পসহ সাধারণ মানুষের জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন দিক উপস্থিত ছিল এবং সম্ভ্রান্ত ও নিম্নবর্গের মধ্যকার পার্থক্য প্রকট ছিল।
সাধারণভাবে, মুকুন্দরামের "অভয়া মঙ্গল" কাব্য এমনভাবে লেখা হয়েছে যে এটি শুধু ধর্মীয় বা কবিতা নয়; একাডেমিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মধ্যযুগীয় বাংলার সমাজ ও জীবনযাত্রার মূল্যবান উপস্থাপনা। তাই তাকে মধ্যযুগীয় সমাজের জীবনবৃত্তান্তের একটি প্রতিবিম্ব বলা যায়, যেখানে সমাজের অসংখ্য স্তরের মানুষের সুখ-দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও মঙ্গলের অন্বেষণ তুলে ধরা হয়েছে.
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তার রচিত গ্রন্থের নাম কি? তার কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।
উত্তর: চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বর্ধমান জেলার দামুনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচিত প্রধান গ্রন্থ হল "চণ্ডীমঙ্গল" যা প্রায় বিশ হাজার ছত্রের একটি মঙ্গলকাব্য। তিনি এই কব্যে দেবী চণ্ডীর ਮਹত্ত্ব কীর্তন করার পাশাপাশি মানুষের জীবনসংগ্রাম, সামাজিক বাস্তবতা এবং চরিত্রচিত্রায়ন অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে উপস্থাপন করেন।
মুকুন্দরামের কবি প্রতিভার বিশেষ দিকগুলি হলো:
তাঁর কবিতা শুধুমাত্র ধর্মীয় মঙ্গলকাব্যের সীমাবদ্ধতা থেকে এগিয়ে এসে মানুষের মাটির জীবন, চরিত্র, সুখ-দুঃখকে প্রাণবন্ত করে তোলেছে, যা মধ্যযুগের অন্যান্য কবিদের কবিতায় দেখা যায় না।
তিনি বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী ছিলেন। তাঁর কাব্যধারায় জীবনবোধ, বাস্তবতা এবং সহানুভূতি স্পষ্ট।
মুকুন্দরাম চরিত্রচিত্রায়নে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন; তাঁর কাব্যে ফুল্লরা, মুরারি শীল, ভাঁড়ুদত্ত, দুর্বলা দাসী ইত্যাদি চরিত্র জীবন্ত ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।
তিনি কাব্যের ভাষা, ছন্দ ও অলংকারের ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন, বিশেষ করে উপমা, রূপক এবং সমাসোক্তি প্রভৃতি।
তাঁর "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যের মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নিপুণ পর্যবেক্ষণ ও বাস্তব চিত্রায়নের এক নতুন দিগন্ত সুস্পষ্ট করেন।
মুকুন্দরামের এই কাব্যের মাধ্যমে তিনি শুধু দেব-দেবীর মহিমা গাইছেন না, বরং মানব জীবনের নানা দিকও গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। এজন্য সাহিত্য সমালোচকরা তাকে মধ্যযুগের একজন মহান কবি ও আধুনিক যুগের ঔপন্যাসিকের মতো প্রতিভাবান হিসেবে গ্রহণ করেন.
মুকুল চক্রবর্তীর অভয়ামঙ্গল কাব্যে ভারুদত্ত এবং মুরারি শীল চরিত্র দুটি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: মুকুল চক্রবর্তীর "অভয়ামঙ্গল" কাব্যে ভারুদত্ত এবং মুরারি শীল চরিত্র দুটি মধ্যযুগীয় সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের দুর্বলতা ও স্বার্থপরতার চিত্র তুলে ধরে।
ভারুদত্ত চরিত্রটি মঙ্গলকাব্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। সে কায়স্থ কুলের একজন সাধারণ মানুষ হলেও তার প্রবৃত্তি অনেকটাই স্তরের নিচে, অর্থাৎ সে ধূর্ত, শঠ এবং ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে কাজ করে। ভাঁড়ু দত্তের জীবনী তার আর্থিক দুরবস্থায় আলোকপাত করে, যেখানে সে দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও সামাজিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। তার হিংস্রতা এবং প্রতিশোধের প্রবণতা রাজা কালকেতুর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত, যা শেষ পর্যন্ত তার ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি করে। ভাঁড়ুর চরিত্রের মধ্যে সামাজিক কৌশল ও বাস্তবতার মিশ্রণ দেখা যায়, যেখানে সে একদিকে দুর্বল আর্থিক ব্যাক্তি হলেও অন্যদিকে শক্তি প্রদর্শন ও ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করে।
অন্যদিকে, মুরারি শীল একটি বিদ্বেষপূর্ণ, ধূর্ত ও স্বার্থপর বণিক চরিত্র। সে লোভী, প্রতারণামূলক এবং খুবই পুঁজি সঞ্চয়ে আগ্রহী। মুরারীর চরিত্র আধুনিক সমাজের সমালোচনামূলক একটি প্রতীক, যেখানে তার ধূর্ততা ও স্বার্থপরতা মাঝে মাঝে সত্যিকারের মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে। তার শরীরী ও মানসিক কৌশল, স্ত্রী বাণ্যানীর সাহায্যে চালাকির মাধ্যমে অসংখ্য প্রতারণামূলক কাজ করে থাকে। মুরারি চরিত্রে মুকুল চক্রবর্তীর জীবনদর্শন ও সমাজের অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাকে ধর্মভীরু, স্বার্থপর ও ধূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যিনি দায়িত্ব পালনে অলক্ষ্য কিন্তু সম্পদ অর্জনে অত্যন্ত সচেতন।
সারাংশে, "অভয়ামঙ্গল" কাব্যের এই দুই চরিত্র মধ্যযুগীয় সমাজের নীতিবাক্য এবং মানুষের দুর্বলতাকে জীবন্ত করে তুলেছে। ভারুদত্ত দারিদ্র্য ও সামাজিক অবমাননার মাঝে সংঘর্ষের প্রতীক এবং মুরারি শীল সমাজের অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা ও কপটতার আদর্শ। মুকুল চক্রবর্তীর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে এরা কেবল সাহিত্যিক চরিত্র নয়, বরং বাস্তব জীবনের প্রতিফলন।
অভয়ামঙ্গল কাব্য অবলম্বনে গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: অভয়ামঙ্গল কাব্য, বিশেষত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান রূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই কাব্যের উৎপত্তির প্রধান কারণ ছিল তৎকালীন বাংলা সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় পরিস্থতির প্রতিবিম্ব।
প্রথমত, তুর্কি-আক্রমণের ফলে বাংলা অঞ্চলের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। সেন রাজাদের কমজোরি, উচ্চবর্ণের একচেটিয়া ক্ষমতা এবং নিম্নবর্ণের জনগণের অবহেলা ও অত্যাচারের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুঃখ ও ব্যথার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বৃহৎ দেব-দেবীদের উৎসব, পূজা ও কাহিনী রাসবিহারী জনসাধারণের আশা, আশ্রয় ও মঙ্গল উপলব্ধিতে সাহায্য করে। সুতরাং, মঙ্গলকাব্যগুলির মাধ্যমে দেবী–দেবতাদেরক শারীরিক ও আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যা সামগ্রিকভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা ছিল।
দ্বিতীয়ত, অভয়ামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এই কাব্য রচনার মাধ্যমে যে ব্যক্তিগত ও সাময়িক জীবনের বিপদ-দুর্দশা তুলে ধরেছেন, তা তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র। তার কাব্যে দেবী অভয়া বা চণ্ডীর জীবদ্দশার গল্প বর্ণিত হয়েছে, যিনি শিকারি কালকেতু এবং বণিক ধনপতির সংকট নিরসনে সাহায্য করেন। কবি মুকুন্দরামের আত্মপরিচয়ে দেখা যায় এমন এক বাস্তববোধ, যা ব্যক্তিগত দুঃখবেদনা ও সমাজের রাজনৈতিক সংকটের মিশ্রণ। এই কাব্যের মাধ্যমে দেবীর মহিমা গাথা হয়েছে, কিন্তু এর সাথে সাথে মধ্যযুগের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট ও সংগ্রামেরও গল্প বলা হয়েছে।
অতএব, অভয়ামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তির কারণগুলি মূলত ছিল তৎকালীন বাংলার জাতীয় ও সামাজিক সংকট, ধর্মীয় শতকতা ও সাধারণ মানুষের মঙ্গল কামনা। এই পর্যায়ে দেবীকে যেমন ধর্মীয় শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে, তেমনি কবির ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে, যা কাব্যকে শুধু মঙ্গলকাব্যই নয়, সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে।
অনুপ্রাস অলংকার কাকে বলে? উদাহরণসহ বিভিন্ন প্রকার অনুপ্রাস অলংকারের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর: অনুপ্রাস অলংকার বলতে এক ধরনের শব্দালংকারকে বোঝায় যেখানে একই ব্যঞ্জনধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ বাক্যের মধ্যে একাধিকবার পুনরাবৃত্তি হয়ে ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি করে। সহজ কথায় বলতে গেলে, বাক্যের বিভিন্ন স্থানে একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তির ফলে সৃষ্ট সুরেলা ও ছন্দবদ্ধ ধ্বনিবিত্তিক অলংকারই অনুপ্রাস। উদাহরণস্বরূপ, "কুলায় কাপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে," এখানে 'ক' ধ্বনি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে যা একটি অনুপ্রাস অলংকার।
অনুপ্রাস অলংকারের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে, যা প্রধানত নিচের মতো শ্রেণীভুক্ত করা হয়:
আদ্যানুপ্রাস (আদি+অনুপ্রাস): বাক্য বা ছন্দের শুরুতে একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি। যেমন:
"যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি"
"তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি"
মধ্যানুপ্রাস: বাক্যের মধ্যে একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি। যেমন:
"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা"
অন্ত্যানুপ্রাস (অন্ত্য+অনুপ্রাস): দুটি বা অধিক ছন্দের শেষে একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি। যেমন:
"দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে।"
এখানে 'ডোবে' ও 'লোভে' শব্দের শেষে একই ধ্বনি পুনরাবৃত্ত হয়েছে.
বৃত্ত্যনুপ্রাস: একই ধ্বনি একাধিকবার বাক্যের বিভিন্ন স্থানে পুনরায় ব্যবহৃত হলে।
ছেকানুপ্রাস: একই ব্যঞ্জনগুচ্ছের ক্রমে মাত্র দুবার বন্ধুস্থাপনের মাধ্যমে অনুপ্রাস সৃষ্টি।
শ্রুত্যনুপ্রাস: বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে বিভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনির পুনরাবৃত্তি।
এছাড়া অনুপ্রাসকে সরলানুপ্রাস, গুচ্ছানুপ্রাস, মালানুপ্রাস ইত্যাদি নামে আরও কিছু প্রকার ভাগ করা হয়।
অনুপ্রাস অলংকারে অভিন্ন ধ্বনির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শব্দের সুন্দর ছন্দ ও শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি হয়, যা কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংক্ষেপে, অনুপ্রাস অলংকার শব্দের উচ্চারণে একটি সুনির্দিষ্ট রূপে একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, যা শ্রুতিমাধুর্য ও ছন্দবোধ বৃদ্ধি করে কবিতা বা গানের বিন্যাসকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
উপমা অলংকার কাকে বলে? উপমা অলংকারের শ্রেণীবিভাগ করে আলোচনা করো।
উত্তর: উপমা অলংকার হলো সাহিত্যিক একটি অলংকার যা একটি বাক্যে দুইটি বিজাতীয় (অন্য ধরনের) বস্তুর মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য না দেখিয়ে কেবল তাদের মধ্যে সাদৃশ্য বা মিল প্রদর্শন করে বিশেষ অর্থসৌন্দর্য সৃষ্টি করে। অন্য কথায়, উপমা অলংকারে দুইটি ভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তিকে মিল রেখে তুলনা করা হয়, এবং তুলনামূলক শব্দ যেমন—"মতো", "যেমন", "সদৃশ", "সম", "হেন" ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
উপমা অলংকারের চারটি প্রধান অঙ্গ থাকে—
উপমেয়: যাকে তুলনা করা হয়,
উপমান: যার সঙ্গে তুলনা করা হয়,
সাধারণ ধর্ম: সেই গুণ বা বৈশিষ্ট্য যা উপমেয় ও উপমানে সাধারণ,
সাদৃশ্যবাচক শব্দ: যা তুলনা প্রকাশ করে (যেমন, মতো, সম, যেন)।
উদাহরণ: "জ্যোৎস্না নামে মৃদুপদে ঝাঁপি লয়ে লক্ষ্মীর মতন।" এখানে 'জ্যোৎস্না' উপমেয়, 'লক্ষ্মী' উপমান, 'মতন' সাদৃশ্যবাচক শব্দ, আর 'মৃদুপদে' হলো সাধারণ ধর্ম।
উপমা অলংকারের প্রধান শ্রেণীবিভাগ ছয়টি—
১. পূর্ণোপমা: যেখানে উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দ—চারটি অঙ্গই স্পষ্ট উল্লেখ থাকে।
উদাহরণ: "আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণদীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম।"
(উপমেয়—ছুরি, উপমান—প্রভাত রশ্মি, সাধারণ ধর্ম—তীক্ষ্ণ, তুলনাবাচক শব্দ—সম)।
২. লুপ্তোপমা: যেখানে উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম বা সাদৃশ্যবাচক শব্দের কোনো একটি বা একাধিক অঙ্গ অনুল্লিখিত থাকে।
উদাহরণ: "পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।" (এখানে সাধারণ ধর্ম লুপ্ত)।
৩. মালোপমা: যেখানে একটি উপমেয়ের সঙ্গে একাধিক উপমান তুলনা করা হয়।
উদাহরণ: "তোমার সে-চুল জড়ানো সুতার মতো, নিশীথের মেঘের মতন।" (উপমেয়—চুল, উপমান—সূতা, মেঘ)।
৪. স্মরণোপমা: কোনো বস্তু দেখে তার সমধর্মের অন্য একটি বস্তুর স্মৃতি মনে পড়লে সেই তুলনাকে স্মরণোপমা বলে।
উদাহরণ: "কালো জল ঢালিতে সই কালা মনে পড়ে।"
৫. বস্তু-প্রতিবস্তুভাবের উপমা: উপমেয় ও উপমান একই সাধারণ ধর্মের হলেও ভাষায় ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।
উদাহরণ: "দারুণ নখের ঘা হিয়াতে বিরাজে, রক্তোৎপল ভাসে হেন নীলসরো মাঝে।"
৬. বিম্ব-প্রতিবিম্বভাবের উপমা: উপমেয় ও উপমানের ধর্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সূক্ষ্ম সাদৃশ্য বোঝায়।
উদাহরণ: "আগুনে যেমন সব বিষ যায়, প্রেমেও তেমনি সকলি শুচি।"
এইভাবে উপমা অলংকার সাহিত্য ভাষার সৌন্দর্য ও মাধুর্য বৃদ্ধি করে তুলনা ও সাদৃশ্যের মাধ্যমে কাব্যিক চমৎকারত্ব সৃষ্টি করে।
রূপক অলংকার কাকে বলে? রূপক অলংকারের প্রকারভেদ উদাহরণসভা আলোচনা করো।
উত্তর: রূপক অলংকার হল একটি সাহিত্যিক অলংকার যেখানে বিষয়ের (উপমেয়) অপরাপর না ঘটিয়ে, অর্থাৎ উপমেয়কে সরাসরি উল্লেখ না করে, তার ওপর অন্য একটি বিষয়ের (উপমান বা রূপ) অভেদ আরোপ করা হয়। এতে শব্দগত সাদৃশ্যের চেয়ে গভীর অর্থসৌন্দর্য তৈরি হয়। সহজ ভাষায়, যে অলংকারে উপমেয় ও উপমানের সাদৃশ্যের মাঝে ভেদ থাকে না, মানে উপমেয় সম্পূর্ণরূপে উপমানের রূপ ধারণ করে, তাকে রূপক অলংকার বলে। এতে উপমেয় ও উপমান এক হয়ে যায় এবং অর্থের গভীরতা বাড়ে।
রূপক অলংকারের প্রকারভেদ ও উদাহরণ
১. নিরঙ্গরূপক অলংকার
এই রূপকে কোনো অঙ্গ (বস্তুর অংশ) বা গুণ বাদ না দিয়ে একটি উপমেয়ের ওপর এক বা একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়।
নিরঙ্গরূপক দুই প্রকার:
ক) কেবল নিরঙ্গরূপক: যেখানে একটি উপমেয়ের ওপর একটি উপমানের অভেদ আরোপ হয়।
উদাহরণ:
"শিশুফুলগুলি তোমারে ঘেরিয়া ফুটে।"
এখানে 'শিশু' উপমেয় ও 'ফুলগুলি' উপমান।
খ) মালা নিরঙ্গরূপক: যেখানে একটি উপমেয়ের উপর একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ হয়।
উদাহরণ:
"শীতের ওঢ়নি পিয়া গিরীষের বা বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।"
২. সাঙ্গরূপক অলংকার
এই রূপকে যেখানে বিভিন্ন অঙ্গসহ উপমেয়ের ওপর বিভিন্ন অঙ্গসহ উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়।
অর্থাৎ উপমেয় ও উপমানের অঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে অভেদযুক্ত এবং একত্রে কাজ করে।
উদাহরণ:
"সৌন্দর্য পাথারে যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী"
এখানে 'সৌন্দর্য' উপমেয় এবং 'পাথার' উপমান, একসাথে তাদের অঙ্গগুলি 'বেদনা', 'মন', 'তরী' ইত্যাদি যুক্ত।
৩. পরম্পরিত রূপক অলংকার
যেখানে একটি উপমানের ওপর অর্থের অভেদ আরোপের কারণে অন্য একটি উপমেয়ের ওপর অন্য একটি উপমানের অভেদ সৃষ্টি হয়।
অর্থাৎ রূপকের একটি পরম্পরা বা ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠে।
উদাহরণ:
"তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছো ভবিষ্যৎ আর
অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা।"
এখানে প্রথম উপমান 'ধোঁয়া' যেটি ‘দীর্ঘশ্বাস’ উপমেয়ের ওপর অভেদ আরোপ করে, তা থেকে পরবর্তী উপমান 'আগুন' ও 'ছাই' অনুশোচনার ও উৎসাহের ওপর অভেদ সৃষ্টি করে।
৪. অধিকাররূঢ় রূপক
যেখানে উপমানের ওপর বাস্তব, অবাস্তব বা কল্পিত কোনো অধিকার বা ক্ষমতার অভেদ আরোপ করা হয়।
উদাহরণ:
"তুমি অচপল দামিনি।"
সংক্ষেপে, রূপক অলংকার শব্দের বাইরে গিয়ে গভীর অর্থ প্রকাশ করে যেখানে উপমান এবং উপমেয়ের মধ্যেকার ভেদ পুরোপুরি মিলিয়ে যায় এবং তা সাহিত্যকে এক বিশেষ রূপে মাধুর্যপূর্ণ করে তোলে। এর প্রধান প্রকারভেদ হলো নিরঙ্গরূপক (কেবল ও মালা নিরঙ্গ), সাঙ্গরূপক, পরম্পরিত রূপক ও অধিকাররূঢ় রূপক.
অলংকার কাকে বলে? শব্দালংকার ও অর্থালংকারের সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ তাদের শ্রেণীবিভাগ করে।
উত্তর: অলংকার বলতে কাব্যের এমন একটি রচনা কৌশলকে বোঝায় যা ভাষাকে সুসজ্জিত ও সুমধুর করে তোলে। কাব্যের শব্দ এবং অর্থকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে যেটি পাঠকের হৃদয়গ্রাহী হয়, তাকে অলংকার বলা হয়। শব্দের সাধারণ অর্থের বাইরে এক ধরনের চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করাই অলংকারের মূল বৈশিষ্ট্য।
অলংকার সংজ্ঞা
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে:
যে গুণ দ্বারা ভাষার শক্তিবর্ধন ও সৌন্দর্য সম্পাদন হয়, তাকে অলংকার বলে।
শব্দে অতিরিক্ত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যেভাবে ভাষাকে সজ্জিত করা হয় তাকে অলংকার বলা হয়।
অলংকারের শ্রেণীবিভাগ
অলংকার প্রধানত দু’ প্রকার:
শব্দালংকার
অর্থালংকার
১. শব্দালংকার
শব্দ বা ধ্বনির উপর ভিত্তি করে যেসব অলংকার গঠিত হয়, সেগুলোকে শব্দালংকার বলে। শব্দের উচ্চারণ ও ধ্বনির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
বৈশিষ্ট্য:
শব্দ বা ধ্বনি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়।
শব্দ বা বর্ণগুচ্ছের পুনরাবৃত্তি কাব্যের ধ্বনি সুন্দর করে তোলে।
শব্দালংকার ধ্বনিগত অলংকার।
শব্দালংকারের প্রকারভেদ:
১. অনুপ্রাস: একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ একাধিকবার ব্যবহৃত হলে যেমন—
"কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে"
২. যমক: একই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অর্থসহ বা নিরর্থকভাবে একাধিকবার ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ (সার্থক যমক):
"রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি"
৩. শ্লেষ: একটি শব্দের মাধ্যমে দুই অর্থ প্রকাশ করা হয়।
উদাহরণ:
"জগৎটা কার বশ?" (টাকা অর্থে এবং অন্য অর্থে ব্যবহৃত)
৪. বক্রোক্তি: কোনো অর্থকে প্রশ্ন, ব্যঙ্গ বা অন্য ভঙ্গিতে প্রকাশ করা।
৫. পুনরুক্তবদাভাস: একটি শব্দ বা অংশ বাক্যে পুনরাবৃত্তি হয়।
২. অর্থালংকার
অর্থের বৈচিত্র্য দ্বারা কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে যে অলংকার, তাকে অর্থালংকার বলে। অর্থালংকারে শব্দের অর্থই মূল এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে, ধ্বনি গৌণ।
বৈশিষ্ট্য:
অর্থামতে বিচিত্রতা সৃষ্টি করে।
শব্দ পরিবর্তন হলেও অর্থের সৌন্দর্য অপরিবর্তিত থাকে।
অর্থের প্রয়োগে কাব্যকে রঙিন করে তোলে।
অর্থালংকারের প্রধান শ্রেণীবিভাগ:
১. সাদৃশ্যমূলক অলংকার
২. বিরোধমূলক অলংকার
৩. শৃঙ্খলামূলক অলংকার
৪. ন্যায়মূলক অলংকার
৫. গূঢ়ার্থমূলক অলংকার
সারসংক্ষেপ
অলংকারের ধরন | সংজ্ঞা | বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ | শ্রেণীবিভাগের নমুনা |
---|---|---|---|
শব্দালংকার | শব্দ বা ধ্বনির উপর ভিত্তি করে তৈরি সৌন্দর্য | ধ্বনি মাধুর্য সৃষ্টি, যেমন অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ ইত্যাদি | অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, পুনরুক্তবদাভাস |
অর্থালংকার | শব্দের অর্থের বৈচিত্র্যের মাধ্যমে সৌন্দর্য | অর্থের বৈচিত্র্য, যেমন সাদৃশ্য, বিরোধ, শৃঙ্খলা ইত্যাদি | সাদৃশ্যমূলক, বিরোধমূলক, শৃঙ্খলামূলক, ন্যায়মূলক, গূঢ়ার্থমূলক |
অতএব, অলংকার হলো কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য শব্দ ও অর্থকে সমন্বয় করে বিধৃত কাব্যশৈলী যার প্রধান দুই ধারা শব্দালংকার ও অর্থালংকার।
উৎপেক্ষা অলংকার কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণীবিভাগ উদাহরণসহ আলোচনা করো।
উত্তর: উৎপেক্ষা অলংকারের সংজ্ঞা
উৎপেক্ষা অলংকার হলো বাংলা সাহিত্যের একটি অর্থালংকারের ধরণ, যা সাদৃশ্যের কারণে উপমেয় (যে বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা হয়) কে উপমান (যার সাহায্যে তুলনা করা হয়) বলা হলেও কবিতায় তা নিয়ে প্রবল সন্দেহ বা সংশয় থাকে। এই সংশয়টি কবিত্বপূর্ণ এবং কবি যখন উপমেয়কে উপমান বলে একটু সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশ করেন, তখন যে অর্থের সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তাকে উৎপেক্ষা অলংকার বলা হয়।
সারাংশে বলতে গেলে, উৎপেক্ষা অলংকারে উপমেয় ও উপমানের মধ্যে গভীর সাদৃশ্যের কারণে উপমেয়কে উপমান বলে ভাবতে যে প্রবল সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশ পায়, সেটাই উৎপেক্ষা অলংকার.
বৈশিষ্ট্য
উৎপেক্ষা অলংকারের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
উপমেয় ও উপমান উভয়ই উপস্থিত থাকে।
উপমেয় ও উপমানের মধ্যে গভীর সাদৃশ্য থাকে।
উপমেয়কে উপমানে পরিণত মনে করে প্রবল সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশ পায়।
সংশয় বা সন্দেহ কবিত্বপূর্ণ হয়, অর্থাৎ সে সংশয় সাধারণ সন্দেহ নয়, বরং সাহিত্যিক সৌন্দর্যের জন্য।
সংশয় প্রকাশের জন্য কবি নির্দিষ্ট সংশয়সূচক শব্দ যেমন: “যেন”, “মনে হয়”, “বুঝি”, “জানি” প্রয়োগ করে থাকেন।
উপমানকে উপমেয় থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, অর্থাৎ উপমানকে সত্য বা প্রধান মনে হয়.
শ্রেণীবিভাগ
উৎপেক্ষা অলংকার দুই রকম শ্রেণীতে বিভক্ত:
বাচ্যোৎপ্রেক্ষা
এই ধরনের উৎপেক্ষা অলংকারে সংশয়সূচক শব্দ যেমন - "যেন", "মনে হয়", "বুঝি", "জানি" ইত্যাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। এই শব্দগুলোর মাধ্যমে সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশ পায়।
উদাহরণ:
"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।" — সুকান্ত ভট্টাচার্য
এখানে "যেন" শব্দটি সংশয়সূচক এবং ‘পূর্ণিমা চাঁদ’কে ‘ঝলসানো রুটি’ বলে ভাবতে প্রবল সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে.
প্রতীয়মান উৎপেক্ষা
এই ধরণের উৎপেক্ষায় সংশয়সূচক শব্দ স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও সংশয়ের ভাব অর্থ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
উদাহরণ:
"হাতে মসী মুখে মসী মেঘে ঢাকা শিশু শশী।"
এখানে স্পষ্ট সংশয়সূচক শব্দ না থাকলেও ‘শিশু শশী’-কে ‘মসী’-এর সঙ্গে তুলনা করে সংশয়ের ভাব প্রকাশ করা হয়েছে.
উপরোক্ত বিশ্লেষণ অনুসারে, উৎপেক্ষা অলংকার হলো কবিতায় গভীর সাদৃশ্যের কারণে উপমেয়কে উপমানে পরিণত মনে করে সংশয়পূর্ণ ভাব প্রকাশের অর্থালংকার, যার দুটি প্রধান ধরন হলো বাচ্যোৎপ্রেক্ষা ও প্রতীয়মান উৎপেক্ষা। এটি কবিতায় দৃশ্যমান অর্থের স্তর বৃদ্ধি করে এবং পাঠকে ভাবানুবাদে গভীরতা দেয়।
বৃদ্ধের করুন আঁখি দুটি সন্ধ্যা তারা সম রহে ফুটি
উত্তর: "বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি" এই লাইনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "নগরলক্ষ্মী" কবিতার একটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী অংশ। এখানে বুদ্ধের করুণ চোখ দুইটি সন্ধ্যার তারা যেমন মৃদু এবং কোমলভাবে ঝলমল করে, ঠিক তেমনি তাঁর দয়া এবং করুণার প্রতিফলন করা হয়েছে। এই পংক্তি দিয়ে রচিত হয়েছে মানবতার করুণা ও দুঃখের গভীরতা, যা বুদ্ধের চোখের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এই কবিতায় বুদ্ধের করুণ চোখ দুর্ভিক্ষে ক্ষুধার্তদের জন্য যে সমবেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করে তা চিত্রিত হয়েছে, যেখানে সে সন্ধ্যাতারার মতো শান্ত এবং মধুর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি মানুষের প্রতি সহানুভূতি, দয়া, এবং কর্তব্যবোধের প্রতীক।
সুতরাং এই লাইনটি মূলত বুদ্ধের করুণাময় চোখের সৌন্দর্য এবং মানবিক দুঃখ বোধের প্রতীক, যা সন্ধ্যার তারার মতো ঝলমলে এবং পবিত্র। এটি মানবকল্যাণে তাঁর গভীর চিন্তা ও অনুভূতির প্রতিফলন.
হে দরিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান।
উত্তর: "হে দরিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান" — এই পংক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার অন্তর্গত।
এটি কবির মানবপ্রেম ও বিনম্রতার এক গভীর প্রকাশ। এখানে কবি দরিদ্র মানুষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন — কারণ তাদের সংস্পর্শ, তাদের কষ্ট ও জীবনের লড়াই কবিকে হৃদয়ে সমৃদ্ধ করেছে, মানবিক বোধ গভীর করেছে, এবং বড়ত্ব দিয়েছে।
ভাবার্থ:
দরিদ্রের দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম ও সহনশীলতা দেখেই কবির হৃদয়ে করুণা, সহানুভূতি ও মমত্ববোধ জন্মেছে। এই অনুভূতিই কবিকে সত্যিকারের "মহান" করেছে — যা ধন-সম্পদ বা ক্ষমতা দিয়ে সম্ভব নয়।
🌸 অবশ্যই সবাইকে শেয়ার করে। 👁️🗨️