ভারতীয় দর্শনে সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য গুলি আলোচনা করো এটি কি কি চারটি পুরুষার্থ নিয়ে আলোচনা কর।
Ans: ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষ্যগুলি নিম্নরূপ:
ভারতীয় দর্শনে প্রকৃতি কেন্দ্রিকতা, ধর্মভিত্তিকতা, বৈচিত্র্যতা, অন্তরমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, শাখা প্রশাখাযুক্ত হওয়া, স্বাধীনতা মূলক চিন্তা, যুক্তিবাদী হওয়া এবং চর্চা মূলক দিক রয়েছে। এখানে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং জীবন ও সত্যের অনুসন্ধান ও উপলব্ধির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তত্ত্বজ্ঞানের পাশাপাশি জীবনে সত্য প্রতিষ্ঠা করাই প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া, দুঃখ-বোধ এবং দুঃখমুক্তির পথ নির্ধারণ করাও ভারতের দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিজ্ঞতা ও ধ্যানের মাধ্যমে সত্যের ধ্যানস্থ হওয়ার উপায়ও নির্দেশিত হয়েছে.
ভারতীয় দর্শনের প্রধান লক্ষ্য বা পুরুষার্থ চারটি রয়েছে, যা মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে পরিচিত এবং হিন্দুধর্মের মৌলিক ধারণা:
ধর্ম (Dharma): নৈতিক-নৈতিকতা ও সামাজিক কর্তব্য। এটি জীবনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ম ও দায়িত্বের প্রতীক।
অর্থ (Artha): জাগতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, অর্থাৎ জীবিকার উপার্জন ও সামাজিক সামার্থ্য।
কাম (Kama): পার্থিব সুখ ও কামনা, আনন্দ লাভের উদ্দেশ্য।
মোক্ষ (Moksha): আধ্যাত্মিক মুক্তি বা পুণর্জন্ম থেকে মুক্তি, আত্মার চিরস্থায়ী মুক্তি।
এই চারটি পুরুষার্থ মানুষের জীবনের সার্থকতা ও পূর্ণতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য স্তম্ভ। প্রথম তিনটি (ধর্ম, অর্থ, কাম) সাধারণত গৃহস্থ আশ্রমের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে মোক্ষ ব্যক্তিগত ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে পরিগণিত। ধর্মশাস্ত্র এবং মহাকাব্য যেমন রামায়ণ ও মহাভারতে এই চারটি পুরুষার্থের মাধ্যমে যথাযথ জীবনযাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে.
সংক্ষেপে, ভারতীয় দর্শন মানুষের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনের গভীর বিশ্লেষণ ও অন্বেষণ যা চারটি পুরুষার্থ (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) এর মাধ্যমে জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। এই দর্শন জীবনে সত্যের অনুসন্ধান এবং নৈতিকতা, অর্থনৈতিক উন্নতি, পার্থিব সুখ ও মুক্তির সমন্বয় সাধনে উৎসাহিত করে।
চার্বাকরা প্রত্যক্ষকেএ একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন কেন আলোচনা কর।
Ans: চার্বাক দর্শন অনুযায়ী প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলা হয়। এর কারণগুলো হলো:
প্রত্যক্ষ হল বস্তুর অস্তিত্বের সূচক; যে বস্তু প্রত্যক্ষ করা যায়, সেটিই বাস্তব এবং যার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, সেটিকে অবাস্তব মনে করা হয়। তাই চার্বাকরা শুধু ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুকেই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে।
প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্পষ্ট, অভ্রান্ত এবং সংশয়মুক্ত। ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সরাসরি সংযোগের কারণে এই জ্ঞান নিশ্চিত এবং এ সম্পর্কে কোন সংশয় থাকে না। অন্যদিকে অনুমান, উপমান ও শব্দ মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান সন্দেহমুক্ত নয়।
চার্বাকদের মতে, অনুমান, উপমান এবং শব্দ সবই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল এবং নিজে থেকে যথার্থ প্রমাণ হতে পারে না। সুতরাং এই ধরনের প্রমাণকে তারা গ্রহণ করেন না।
প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলো সকল প্রমাণের মূল, যার ভিত্তিতে অন্য প্রমাণগুলি গড়ে উঠে। যদি অন্য কোনো প্রমাণে সংশয় দেখা দেয়, তবে সেই সংশয় দূর করতে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সাহায্য নিতে হয়।
নির্দোষ ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ এবং বিশ্বাসযোগ্য; তাই চার্বাকরা বিশ্বাস করেন এটি একমাত্র সঠিক প্রমাণ।
এই কারণগুলো থেকেই চার্বাক দর্শন প্রত্যক্ষকেই শুধুমাত্র একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে।
অনুমান যথার্থ জ্ঞানের উৎস নয় চার্বাকরা কিভাবে এই মদ প্রতিষ্ঠাতা করেন।
Ans: চার্বাক দর্শন একটি প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী ও নাস্তিক দর্শন, যেখানে অনুমান প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হয়েছে। চার্বাকরা মনে করতেন যে যথার্থ জ্ঞানের উৎস একমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণ, অর্থাৎ সরাসরি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা তথ্য। অনুমানকে তারা অন্ধকারে লাফ দেওয়ার মতো একটি অসম্পূর্ণ ও সম্ভাবনাময় জ্ঞান হিসেবে দেখেন, যা স্পষ্ট ও নির্ভুল জ্ঞান দিতে সক্ষম নয়।
চার্বাকদের অনুসারে, অনুমান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান সংশয় ও ত্রুটিপূর্ণ হয়, কারণ অনুমানের হেতু এবং সাধ্যের ব্যাপ্তি ঠিক মতো নির্ণয়যোগ্য নয়। অনুমানে দেশ, কাল এবং স্বভাবের পরিবর্তনের কারণে দ্রুততর ও চিরস্থায়ী ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, যারা আপ্তবাক্য বা বিশ্বস্ত মহাজ্ঞানীর উক্তি থেকে জ্ঞান লাভের কথা বলেন, তাদের কথাও চার্বাকরা বিশ্বাস করেননি, কারণ তাদের সত্যতা নির্ণয়ে অনুমানের সাহায্য নিতে হয়, যা চক্রাকারে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়।
চার্বাক দর্শনমতে, যা কিছু ইন্দ্রিয় দ্বারা সরাসরি উপলব্ধ তা ছাড়া অন্য কোনো জ্ঞান, যেমন অনুমান বা আপ্তবাক্য, বৈধ জ্ঞানের উৎস হতে পারেনা। এ কারণে তারা অনুমানকে যথার্থ জ্ঞান হিসেবে স্বীকার করেননি এবং তাই অনুমানকে কোনও মদ বা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করেননি বরং প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই তারা জ্ঞানের মূল ভিত্তি মানতেন.
সারসংক্ষেপে, চার্বাকরা অনুমানকে যথার্থ জ্ঞানের উৎস মনে করেনি কারণ তারা প্রত্যক্ষ প্রমাণের চেয়ে অনুমানের জ্ঞান সংশয়াতীত এবং ত্রুটিপূর্ণ বলে বিশ্বাস করত এবং তাই অনুমানের মাধ্যমে স্থায়ী ও নিশ্চিত জ্ঞান প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে দাবি করত।
আরো তথ্য বা প্রসঙ্গ জানতে চাইলে জানাবেন।
বৌদ্ধ দর্শনে অষ্টাঙ্গিক মার্গ সবিস্তারে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ দর্শনে অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো মানুষের দুঃখ বা দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভের পথে গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রদত্ত আটটি মূল পথের সমষ্টি। এটি বৌদ্ধ ধর্মের চতুর্থ আর্য সত্যের অংশ, যেখানে বুদ্ধ বলেন যে, দুঃখ নিরোধের উপায় আছে এবং তা অর্জনের জন্য এই আটটি পথ অনুসরণ করতে হবে।
অষ্টাঙ্গিক মার্গের আটটি পথ হলো:
সম্যক দৃষ্টি (Right View)
জীবনের চারটি আর্য সত্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান লাভ করা। দুঃখ, তার কারণ, দুঃখের নিবারণের উপায় এবং তার ফলাফল সম্পর্কে পারদর্শী হওয়া।
সম্যক সংকল্প (Right Intention)
সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত সৎ সংকল্প, যেমন দুঃখ ত্যাগ, অহিংসা এবং করুণা ভাবধারা গ্রহণ করা।
সম্যক বাক্য (Right Speech)
মিথ্যা বক্ নয়, অপদ্রব নয়, পরনিন্দা নয়, কটু কথা নয়; সত্য ও সদয় ভাষণ ব্যবহার করা।
সম্যক কর্মান্ত (Right Action)
অহিংসা পালন, চুরি বর্জন, ভুল আচরণ পরিহার ইত্যাদি সৎ ও শুদ্ধ কর্মচার।
সম্যক আজীব (Right Livelihood)
অন্যায় ও অন্যদের ক্ষতি না করে সৎ পেশা নির্বাহ করা।
সম্যক ব্যায়াম (Right Effort)
কু-চিন্তা ও কু-বৃত্তি দমন করে মনকে সদৈব সৎ চিন্তা ও সৎ বৃত্তিতে নিয়োজিত রাখা।
সম্যক স্মৃতি (Right Mindfulness)
জীবনের সবকিছুর অনিত্য প্রকৃতি মননে স্থির রাখা এবং কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত থাকা।
সম্যক সমাধি (Right Concentration)
একাগ্রতা এবং মাধ্যমে ধ্যানের সাহায্যে মুক্তি ও নির্বাণ লাভের স্তরে পৌঁছানো।
অষ্টাঙ্গিক মার্গকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
সম্যক প্রজ্ঞা (সঠিক দৃষ্টি ও সংকল্প)
সম্যক শীল (সঠিক বাক্য, কর্ম ও আজীবন)
সম্যক সমাধি (সঠিক প্রচেষ্টা, স্মৃতি ও সমাধি)
এই আটটি পথ ধারাবাহিকভাবে পালন করার মাধ্যমে মানুষ জীবনের সকল দুঃখ এবং সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে ও নির্বাণ লাভ করতে পারে। বৌদ্ধ দর্শনে এই পথকে মধ্যপথ বলা হয় যা অতিরিক্ত কঠোরতা বা অতিরিক্ত প্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখে জীবন যাপনের সঠিক মাধ্যম নির্দেশ করে।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি এবং চারটি আর্য সত্যের চতুর্থ সত্যের সত্যস্থাপন যা মানুষের মুক্তি ও শান্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
এভাবেই বৌদ্ধ দর্শন অষ্টাঙ্গিক মার্গকে জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রত্যক্ষ জীবনচর্চায় এর বাস্তব প্রয়োগের গুরুত্ব প্রচার করে।
বৌদ্ধদের কার্যকারণ মতবাদ বা পতিত্যসমুৎপাদবাদ তত্ত্বটি সবিস্তারে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম মৌলিক তত্ত্ব হলো প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ বা কার্যকারণ তত্ত্ব, যা বাংলায় "নির্ভরশীল উৎপত্তি" বা "নির্ভরশীল উদ্ভব" হিসেবে পরিচিত। এই তত্ত্ব বৌদ্ধ দর্শনের কেন্দ্রীয় শিক্ষা, যেখানে বর্ণনা করা হয় যে সমস্ত কিছুই একাকার বা স্বতন্ত্র নয়, বরং একে অপরের উপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয় এবং একে অপরের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ, কোনো একটি ঘটনা বা বস্তু নিজের থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব লাভ করে না, বরং তা বিভিন্ন কারণ এবং শর্তের সমন্বয়ে উদ্ভূত হয়।
কার্যকারণ তত্ত্বের মূলভাব হলো:
প্রত্যেক কার্য বা ঘটনা একটি বা একাধিক কারণ এবং শর্তের উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয়।
কোনো কারণ থাকলেই কার্য উৎপন্ন হয়, আর কারণ বন্ধ হলে কার্যও বন্ধ হয়।
সম্পূর্ণ স্বাধীন বা স্বতন্ত্র কোনো সত্তা বা ঘটনা নেই; সমস্ত কিছু পারস্পরিক শর্তসাপেক্ষ।
এই তত্ত্বের মাধ্যমে টিকে আছে বৌদ্ধধর্মের দুঃখের উৎপত্তি ও তার নিরোধের ব্যাখ্যা।
বৌদ্ধ দর্শনে এই তত্ত্বকে বারোটি ধাপে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয় যাকে "বারো নিদান" বা "দ্বাদশ অঙ্গ" বলা হয়। এদের মাধ্যমে জন্ম, প্রাণ, বেদনা, তৃষ্ণা, বয়স ও মৃত্যু ইত্যাদি জীবনের চক্র ও পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, "অবিদ্যা" (অজ্ঞতা) প্রথম ধাপ যা অন্যান্য সব ধাপের কারণ হয়, এবং এর ফলে বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা দুঃখের মূল।
এই তত্ত্বের মাধ্যমে বৌদ্ধরা বোঝাতে চায় যে দুঃখের উৎপত্তি একটি কার্যকারণ-নির্ভর প্রক্রিয়া, এবং যদি সেই কারণ ও শর্তগুলি বন্ধ করা যায়, তবে দুঃখও নির্মূল করা যেতে পারে। এভাবেই কার্যকারণ তত্ত্ব দুঃখের সমাধানের পথ নির্দেশ করে।
বিশেষ করে এই তত্ত্বের মাধ্যমে বৌদ্ধ দর্শন পুনর্জন্ম ও কর্মফল সম্পর্কেও ব্যাখ্যা প্রদান করে, যেখানে আত্মা বা স্থায়ী সত্তার অনুপস্থিতি (অনাত্মবাদ) তুলে ধরা হয়েছে। কারণগুলো পরস্পর নির্ভরশীল হওয়ায় কোনো স্থায়ী "আমি" বা সত্ত্বা নেই, বরং অস্তিত্ব হলো ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ও শর্তসাপেক্ষ।
সংক্ষেপে, বৌদ্ধদের কার্যকারণ বা প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ তত্ত্ব হলো:
সবকিছু অন্যকিছুর উপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়
কারন-কার্য সম্পর্কের মাধ্যমে দুঃখ ও তার নিরোধ ব্যাখ্যা করা
বারো ধাপে জীবনের পুনর্জন্ম ও দুঃখের চক্র বিশ্লেষণ
আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার ও পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ
এই তত্ত্ব বৌদ্ধ দর্শনের দার্শনিক ভিত্তি হিসাবে মানব জীবনের দুঃখ, তার কারণ এবং মুক্তির পথ বোঝায়.
জৈন মতে অনেকানন্দবাদ বিস্তারিত আলোচনা কর।
Ans: জৈন মতে অনেকানন্দবাদ (Anekantavada) হলো একটি দার্শনিক মতবাদ যা সত্য ও বাস্তবতার বিভিন্ন দিক বা পক্ষে বিশ্বাস করে এবং বোঝায় যে কোনও একটি কঠোর বা একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সত্যকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না। এই মতবাদ অনুসারে, সত্য এমন একটি জটিল ও বহুমুখী বিষয় যা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে এবং প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি সত্যের একটি আংশিক প্রকাশ। তাই কোন একক দৃষ্টিকোণকে সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়।
অনেকানন্দবাদের মূল ভাবনা হলো "বহুতরফা" বা "বহুমুখীত্ব" — অর্থাৎ পরম সত্য অনেকগুলি দিক থেকে উপস্থাপিত হতে পারে। জৈন ধর্মে এই মতবাদ পরম সত্য ও অস্তিত্বের প্রকৃতিকে বোঝার জন্য প্রয়োগ করা হয়। এই তত্ত্বটি মূলত স্বীকার করে যে:
সত্য একতরফা বা একমুখী নয়, বরং এর অনেক দিক রয়েছে।
প্রত্যেক ব্যক্তি বা দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সত্যের কিছু না কিছু অংশ দেখা বা বোঝা যায়, তবে সম্পূর্ণ সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
ভাষা ও মানব মনের সীমাবদ্ধতার কারণে সত্যের সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব নয়, তাই ভাষায় প্রকাশিত সত্য হলো সত্যের আংশিক প্রতিফলন।
সত্য উপলব্ধির জন্য বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে এবং একেকটি ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত حقیقتকে সম্মান করতে হবে।
এই ধারণাটিকে প্রায়ই "অন্ধের হাতির স্পর্শ" উপমার মাধ্যমে বোঝানো হয় যেখানে একেক অন্ধ ব্যক্তি হাতির আলাদা আলাদা অংশ স্পর্শ করে হাতিটিকে আলাদা আলাদা রূপে বর্ণনা করে। প্রত্যেকের বর্ণনা আংশিক হলেও সম্পূর্ণ হাতির ধারণা পেতে হলে সকলের বর্ণনা প্রয়োজন।
অনেকানন্দবাদ জৈন দার্শনিক চিন্তার হৃদয় হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো স্যাদবাদ ও নয়বাদ। স্যাদবাদ বলে যে প্রতিটি বিবৃতি একটি শর্ত বা সীমাবদ্ধতার সাথে সত্য হতে পারে এবং নয়বাদ বিশেষ কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সত্যকে বিবেচনা করে।
জৈন ধর্মে এই মতবাদ এমন এক সামাজিক ও বৌদ্ধিক সহিষ্ণুতা এবং মুক্তমনস্কতার শিক্ষা দেয় যা বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান করে। এটি ধর্মীয় বহুত্ববাদ, অহিংসা এবং অন্যায় ও সংঘাতের প্রত্যাখ্যানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। মহাত্মা গান্ধীও এই অনেকানন্দবাদের মতবাদ থেকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অহিংসার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সংক্ষেপে, জৈন মতে অনেকানন্দবাদ হল—
সত্য বহুপক্ষে এবং বহুমুখী
কোন একক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সত্যের পূর্ণ উপলব্ধি অসম্ভব
সকল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান প্রদর্শন জরুরি
সত্যের সম্পূর্ণ উপলব্ধি শুধু পূর্ণজ্ঞ (অরিহন্ত) ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব
প্রখর সামাজিক ও দার্শনিক সহিষ্ণুতার নমুনা
এভাবেই অনেকানন্দবাদ জৈন দর্শনের মৌলিক ভিত্তি ও দার্শনিক আদর্শ.
ন্যায় মতে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা দাও নির্বিকল্পক ও সব বিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
Ans: ন্যায় মতে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞাঃ
প্রত্যক্ষ অর্থ হলো এমন জ্ঞান বা উপলব্ধি যা সরাসরি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঘটে, যার জন্য আর কোনো প্রমাণক শক্তি বা অন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। এটি অবলম্বনযোগ্য এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলাফল। ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষ প্রধান চারটি প্রমাণের অন্যতম এবং এটি বাহ্যিক বস্তু বা বিষয় সরাসরি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করাই প্রত্যক্ষ বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সরাসরি সংযোগের ফলে উৎপন্ন জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বলা হয়।
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য:
দিক নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ সবিকল্পক প্রত্যক্ষ
অর্থ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর, অব্যক্ত বা নির্দিষ্ট নয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরিণত বা স্পষ্ট স্তর, বচনে প্রকাশযোগ্য
প্রকাশ বচনের দ্বারা প্রকাশ সম্ভব নয় বচনের দ্বারা প্রকাশযোগ্য
প্রতিষ্ঠান অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত জ্ঞান স্পষ্ট ও সুনিশ্চিত জ্ঞান
স্মৃতি ও কল্পনা পূর্বজ্ঞান বা স্মৃতির প্রভাব নেই পূর্বজ্ঞান ও স্মৃতির প্রভাব থাকতে পারে
সত্য-মিথ্যা প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন ওঠে না সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন ও হতে পারে
নাম, গুণ, জাতি নাম, গুণ, জাতির সম্পর্ক থাকে না নাম, গুণ, জাতির সম্পর্ক থাকে
জ্ঞানের প্রকৃতি একটি বস্তুর অস্তিত্বের ওপর অবলম্বিত, বস্তুর প্রকৃতি জানে না বস্তুর গুণ ও স্বরূপ সহ জ্ঞান অর্জন
ছয়টি সন্নিকর্ষ শুধুমাত্র সংযোগ সন্নিকর্ষ প্রযোজ্য সমস্ত ছয়টি সন্নিকর্ষ প্রযোজ্য
প্রমা ও অপ্রমা প্রমা বা অপ্রমা হতে পারে না প্রমা ও অপ্রমা উভয়ই হতে পারে
সংক্ষেপে, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো এমন প্রত্যক্ষ জ্ঞান যা অস্পষ্ট, অবক্ত এবং অনিশ্চিত; এটি প্রধানত বস্তুটির অস্তিত্বের সরল উপলব্ধি। অন্যদিকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো ধারাবাহিক, স্পষ্ট এবং বিবেচিত জ্ঞান যেখানে স্মৃতি ও পূর্বজ্ঞানও জড়িত থাকে এবং যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য। দুটির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ন্যায়দর্শনে উভয়ই প্রত্যক্ষের বিভিন্ন স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়।
সাংখ্য মতে প্রকৃতির অস্তিত্ব আলোচনা কর এর স্বপক্ষে দার্শনিক যুক্তিগুলি আলোচনা কর।
Ans: সাংখ্য দর্শন মতে প্রকৃতি বা প্রকৃতির অস্তিত্ব একটি মৌলিক এবং অপরিহার্য সত্য। সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনের গাণিতিক ও দ্বৈতবাদী শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে বিশ্ব ও জগতের মূলত দুই স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি আছে—পুরুষ (চৈতন্যাত্মা) ও প্রকৃতি (আদি পদার্থ)। সাংখ্য মতে, প্রকৃতি হলো জড়, অচেতন, কিন্তু ক্রিয়াশীল মৌলিক উপাদান, যা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে গঠিত। এই ত্রিগুণের সমতা প্রকৃতির অবস্থা এবং তাদের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে প্রকৃতির বিকৃতি ও জগতের সৃষ্টি ঘটে।
সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতির অস্তিত্বের দার্শনিক যুক্তি
১. দ্বৈতবাদ ও মৌলিক সত্তা স্বীকৃতি:
সাংখ্য দর্শন দৃঢ়ভাবে দ্বৈতবাদী। এটি দুইটি অনন্য সত্তার অস্তিত্ব মেনে চলে—পুরুষ (চেতন সত্তা) ও প্রকৃতি (জড় সত্তা)। প্রকৃতিকে বাদ দিলে পুরুষের অস্তিত্ব স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা অসম্ভব। তাই প্রকৃতি ও পুরুষ দুটোই সত্য এবং নিত্য।
২. সৎকার্যবাদের প্রমাণ:
সাংখ্য দর্শন সৎকার্যবাদের (কার্যকারণবাদ) নীতির ওপর ভিত্তি করে। এর মানে, কোনো কার্য বা ঘটনা তার কারণ হিসেবে বিদ্যমান থাকেই অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায়। প্রকৃতি কোনো অপরিষ্কৃত বা অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান থাকে, যা স্পর্শ করলে তার প্রকাশ বা বিকৃতি ঘটে। তাই প্রকৃতি জগতের উৎপত্তির পূর্বাপর একটি মৌলিক উপাদান।
৩. ত্রিগুণের ভারসাম্য ও জগতের উৎপত্তি:
প্রকৃতি তার গুণত্রয়ের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে স্থিত থাকে। কিন্তু এই ভারসাম্য ভঙ্গ হলে সৃষ্টি ও বিবর্তন ঘটে। প্রকৃতি এই ত্রিগুণের মিশ্রণ ও বিকাশের মাধ্যমেই বহুবিধ ভৌত ও মানসিক ঘটনা সংঘটিত হয়।
৪. সাংখ্য মতে পুরুষের স্বাধীনতা ও প্রকৃতির সক্রিয়তা:
পুরুষ চেতন ও নিষ্ক্রিয়, আর প্রকৃতি অচেতন কিন্তু ক্রিয়াশীল। প্রকৃতির অস্তিত্ব হল পুরুষের অভিজ্ঞতার মাধ্যম, এবং এর ছাড়া জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই প্রকৃতির অস্তিত্বের স্বীকৃতি অপরিহার্য।
৫. বহু পুরুষবাদের প্রমাণে প্রকৃতির অপরিহার্যতা:
সাংখ্য দর্শনে পুরুষের বহুবচন স্বীকার আছে। বিভিন্ন জীবের মাল্টিপল আত্মা বিবেচনায় প্রকৃতির অস্তিত্ব ব্যতীত জীবন ও তার বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা অসাধ্য।
সংক্ষেপে
সাংখ্য মতে প্রকৃতি হল জড়, অচেতন তবে সক্রিয় মৌলিক উপাদান যা শতকের নিয়মে জগতের সকল সৃষ্টি ও বিকাশের কারণ। এর অস্তিত্বের স্বীকৃতির জন্য দ্বৈতবাদ, সৎকার্যবাদ, ত্রিগুণের ব্যবস্থা এবং পুরুষের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রমাণগুলো দার্শনিক যুক্তি সরবরাহ করে। সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনেই বিশ্ব ও জীবনের প্রকৃত চিত্র মেলে।
সুতরাং সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতির অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও তার দার্শনিক ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এটি জগতের মৌলিক বাস্তবতা হিসেবে দেখা হয়।
পুরুষ সম্বন্ধে সাংখ্য মত আলোচনা কর।
Ans: সাংখ্য দর্শনে "পুরুষ" হলো এক অতীন্দ্রিয়, শুদ্ধ সচেতন সত্তা। এটি দেহ, মন, বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়ের সমষ্টি নয়, বরং এদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। সাংখ্য দর্শনের মতে, পুরুষ হলো অজ পরিবর্তনশীল, শাশ্বত এবং নির্বিকার চৈতন্য বা আত্মা, যা সবসময় সচেতন কিন্তু কখনোই জ্ঞেয় বা জ্ঞানের বিষয় নয়। পুরুষ কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস পায় না এবং এটি কোনো প্রভাব বা বিকৃতির সম্পর্কেও থাকে না।
পুরুষের অস্তিত্বের পক্ষে সাংখ্য দর্শনে বেশ কিছু তর্ক দেওয়া হয়েছে, যেমন:
সংঘাতপরার্থত্বাৎ: বিভিন্ন যৌগিক পদার্থ পরস্পরের উদ্দেশ্যে কাজ করলেও তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য থাকে না; তাদের চেতনার প্রয়োজনীয়তা পুরুষ দ্বারা পূরণ হয়।
ত্রিগুণাদির বিপর্যয়: সমস্ত জ্ঞেয় বস্তু ত্রিগুণসম্পন্ন, কিন্তু ত্রিগুণবিহীন এক সচেতন সত্তার প্রয়োজন, যা পুরুষ।
অধিষ্ঠান: দেহ, বুদ্ধি, মন ইত্যাদি সচেতন হয় কারণ তাদের অধিষ্ঠান হিসেবে একটি চেতন পুরুষ রয়েছে।
ভক্তৃভাব: সুখ, দুঃখ, বিষাদ এইসব ভোগের জন্য একজন চেতন ভোক্তার প্রয়োজন, যা পুরুষ।
কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ: দুঃখ থেকে মুক্তির চেষ্টা থেকে বোঝা যায় যে চেতন এক্সচেতনার অস্তিত্ব রয়েছে যাকে পুরুষ বলা হয়।
এছাড়া সাংখ্য দর্শনে পুরুষ এক নয়, বহু। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যে পৃথক পৃথক পুরুষ বা আত্মা আছে, যা তাদের পৃথক জন্ম, মৃত্যু, প্রবৃত্তি প্রভৃতির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
সংক্ষেপে, সাংখ্য দর্শনে পুরুষ হলো চিরন্তন, পরিবর্তনশীল নয়, নিবিড় সচেতনতা বা আত্মা, যা প্রকৃতির (প্রকৃতি বা মায়ার) সাথে মিলিত হয়ে যৌগিক বিশ্বের সৃষ্টি ও বিক্ষোভ ঘটায়। পুরুষ ও প্রকৃতি হলো সাংখ্য দার্শনিক চিন্তার প্রধান দুটি ভিত্তি.
অভাব কাকে বলে? অভাব কয় প্রকার ও কি কি পদার্থ হিসেবে অভাবের শ্রেণীবিভাগ কর।
Ans: অভাব মানে হলো কোন কিছু নেই বা অনুপস্থিতি। অর্থাৎ, যাদের অস্তিত্ব নেই বা যা নেই, সেটাই অভাব। এটি জীবনের একটি বাস্তব এবং মৌলিক সত্য। অর্থনীতিতে অভাব বলতে বোঝায় সীমিত সম্পদ এবং অসীম চাহিদার মধ্যে ফারাক, যার কারণে সর্বোত্তম প্রযুক্তিগত ব্যবস্থায়ও সম্পদের যথেষ্ট ব্যবস্থা করা যায় না।
অভাবের প্রকার ও শ্রেণীবিভাগ:
১. ধরনের ভিত্তিতে অভাব দুই প্রকার:
সংসর্গাভাব: কোনো বস্তুতে অন্য বস্তু বা তার কোনো অংশের অভাব বুঝায়। যেমন, "কলসীতে জল নেই" — এখানে কলসীর সঙ্গে জলের সংসর্গাভাবের অভাব আছে।
অন্যোন্যাভাব: দুইটি বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক আবর্তনের অভাব, অর্থাৎ এক বস্তু আরেকটি নয়। যেমন, হাতি ঘোড়া নয়, চেয়ার টেবিল নয়।
২. বৈশেষিক অর্থে অভাব পদার্থ হিসেবে শ্রেণীবিভাগ:
অভাব একটি নঞর্থক পদার্থ হিসেবে ধরা হয়, যা অন্য কোনো পদার্থের অভাবকে নির্দেশ করে।
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অভাব প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত—অন্যোন্যভাব ও সংসর্গভাব।
সংসর্গভাব আবার তিন প্রকারের: প্রাগভাব (উৎপাদনের পূর্ব অভাব), ধ্বংসভাব (ধ্বংসজনিত অভাব), এবং অত্যন্তভাব (চিরস্থায়ী ও সর্বকালের অভাব)।
এই ধারনাগুলি অনুযায়ী অভাবকে পদার্থ হিসেবেও গণ্য করা হয় এবং এটি আমাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির একটি অংশ, যা কোনো বস্তু বা গুণের অনুপস্থিতির বিষয় প্রকাশ করে। যেমন, "টেবিলের উপর কলম নেই" থেকে আমরা কলমের অভাব উপলব্ধি করি। এছাড়াও অভাব সবসময় কোনো অনুযোগী (অবস্থান) এবং প্রতিযোগী (অভাবগ্রস্ত বস্তু) সাপেক্ষে থাকে.
ভারতীয় দর্শনে আস্তিক ও নাস্তিক সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: ভারতীয় দর্শনে "আস্তিক" ও "নাস্তিক" দুটি প্রধান দর্শনীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়, যা বেদের প্রতি বিশ্বাস বা অ-বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবদ্ধ।
আস্তিক সম্প্রদায়
আস্তিক শব্দের অর্থ হলো যারা বেদ, ঈশ্বর ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখে।
আস্তিকদের সংজ্ঞা তিনভাবে করা হয়:
যারা বেদের জ্ঞানীয় কর্তৃত্ব স্বীকার করে।
যারা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে।
যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে।
ভারতীয় দর্শনের ছয়টি প্রধান আস্তিক দর্শন হলো ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও বেদান্ত।
আস্তিক দর্শন মূলত বেদকে নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের উৎস হিসেবে মানে এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। এছাড়া ঈশ্বরের অস্তিত্বও তারা স্বীকার করে থাকে, যদিও কিছু দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে।
নাস্তিক সম্প্রদায়
নাস্তিক হলেন যারা আস্তিকদের বেদ-বিশ্বাস, আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাগুলো প্রত্যাখ্যান করে।
ভারতীয় দর্শনের চারটি প্রধান নাস্তিক দর্শন হল বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক ও আজীবিক।
নাস্তিক দর্শন বেদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না এবং আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না। উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ ধর্ম "আত্মার অস্তিত্ব নেই" বলে; অনেকে নাস্তিক দর্শনকে বেদের বিরোধী দর্শন হিসেবে গণ্য করে।
নাস্তিক দর্শনশাস্ত্র মূলত স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে এবং প্রথাগত বেদীয় ধর্মবোধের বাইরে তর্ক করে।
ধর্ম ও দর্শনের পার্থক্য
আস্তিক ও নাস্তিক শ্রেণিবিভাজন বেদের প্রামাণ্যতা ও আত্মার ধারণার ভিত্তিতে করা হয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস বা অবিশ্বাস এখানে প্রধান হয়ে উঠে না।
ভারতীয় দর্শনের বাইরের ধর্মীয় ও দার্শনিক আন্দোলন যেমন জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম নাস্তিকের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু তারা নিজস্ব নৈতিকতা ও দর্শন পরিচালনা করে।
সারাংশ
ভারতীয় দর্শনে আস্তিকরা বেদের কর্তৃত্ব ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, অন্তত ছয়টি প্রধান দর্শন এই দৃষ্টিভঙ্গির অধীনে আসে। অন্যদিকে, নাস্তিকরা বেদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েও সংশয় বা অবিশ্বাসী, যার মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক ও আজীবিক দর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই পার্থক্য মূলত ভারতীয় দর্শনের গভীর ভাবগাম্ভীর্য ও আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্যের পরিচায়ক, যা ধর্মীয় ও দর্শনীয় চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে।
চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা চার্বাকদের এই মতবাদটি আলোচনা কর।
Ans: চার্বাকদের "চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা" মতবাদ মূলত দেহাত্মবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদের একটি প্রকাশ। তাদের মতে, আত্মা কোনো স্বতন্ত্র, চিরস্থায়ী, বা অশরীরী সত্তা নয়; বরং এটি দেহের একটি বৈশিষ্ট্য, যা জীবিত অবস্থায় চৈতন্য অর্থাৎ সচেতনতা দ্বারা চিহ্নিত হয়। চার্বাক দর্শনে আত্মা এবং দেহ একে অপর থেকে ভিন্ন কিছু নয়, চৈতন্যবশ দেহই আত্মা হিসেবে পরিচিত হয়।
চার্বাকেরা বিশ্বাস করতেন যে চেতনাসম্পন্ন দেহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকে এবং আত্মা বলতে যা বোঝানো হয় সেটি আসলে ওই চৈতন্য বিশিষ্ট দেহ। তাদের মতে দেহের অতিরিক্ত কোনো আলাদা আত্মার অস্তিত্ব নেই, কারণ এর জন্য কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তাই পরকাল বা পুনর্জন্মের মত ধারণাগোগুলোকে চার্বাকরা অস্বীকার করত। মৃত্যুর পর দেহের ক্ষয়ক্ষতি মানেই চৈতন্যের অবসান, তাই মৃত্যুর পর কোন আত্মার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
চার্বাক দর্শনের মূল যুক্তি হলো, আমরা যা প্রত্যক্ষ করতে পারি তারই অস্তিত্ব স্বীকার করা উচিত, আর আত্মা বা চৈতন্যের ধারণা ছাড়া দেহকে কেন্দ্র করেই জীবনের চেতনাসূচক ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা করা যায়। যেহেতু দেহই চৈতন্যের উৎস, তাই "চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা" এই অবস্থান চার্বাকদের দর্শনের মূল ভিত্তি.
সংক্ষেপে:
চার্বাকদের মতে আত্মা হল দেহের মধ্যে বিরাজকারী চৈতন্য বা সচেতনতা।
দেহ ছাড়া আলাদা, স্বতন্ত্র কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই।
চার্বাক দর্শন অধ্যাত্মবাদবিরোধী এবং পুনর্জন্ম-বিশ্বাস অস্বীকার করে।
মৃত্যুর পর দেহের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে চৈতন্যও বিনষ্ট হয়ে যায়।
এই মতবাদ চার্বাক দর্শনের বস্তুবাদী ও প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বৌদ্ধ দর্শনে চারটি আর্য সত্য বা চত্বারি আর্য সত্যানি সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ দর্শনের ভিত্তি হলো চারটি আর্য সত্য বা চত্বারি আর্য সত্যানি, যা গৌতম বুদ্ধ নিজের জ্ঞানে প্রখ্যাত করেছেন জীবন ও দুঃখ সম্পর্কে গভীর সত্য উপলব্ধি করার জন্য। এই চারটি সত্য মানুষের জীবন দুঃখময় এবং তার উপশমের পথ দেখায়। এর বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:
১. দুঃখ (দুঃখসত্য)
এই প্রথম আর্য সত্য বলে যে, জীবন দুঃখময়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা দুঃখ অথবা অসন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে যায়। সমস্ত বস্তু ক্ষণস্থায়ী এবং সুখের অনুভূতিও অনিত্য। তাই জীবনের বেদনা এবং কষ্ট অবশ্যম্ভাবী।
২. দুঃখের কারণ (সমুদয়সত্য)
দ্বিতীয় আর্য সত্য বলে, জীবনের এই দুঃখের একটি কারণ আছে। সেই কারণ হলো তৃষ্ণা বা আসক্তি—বাস্তব জীবন বা জগতের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়প্রিয় বস্তু বা বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, যা অবিদ্যা, মোহ, রাগ ও দ্বেষের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। এই তৃষ্ণা বারো ধাপের কারণ শৃঙ্খল বা ভবচক্রের মূল অংশ।
৩. দুঃখের নিরোধ (নিরোধসত্য)
তৃতীয় আর্য সত্য হলো, দুঃখের নিরোধ সম্ভব। অর্থাৎ, যদি এই তৃষ্ণা বা আসক্তিকে দূর করা যায় এবং অবিদ্যা বিনষ্ট করা যায়, তাহলে দুঃখের নিবৃত্তি হয়। তখন জন্ম-মরণ চক্র থেকে মুক্তি ও নির্বাণ অর্জিত হয়।
৪. দুঃখ নিরোধের পথ (মার্গসত্য)
চতুর্থ আর্য সত্যে বুদ্ধ বলেন, দুঃখ নিরোধের জন্য একটি পথ আছে, যাকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। এই পথের আটটি উপাদান হলো—সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, এবং সম্যক সমাধি। এই পথ অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
সংক্ষেপে, এই চারটি আর্য সত্য মানুষের জীবনে দুঃখের অস্তিত্ব, তার কারণ, তার অবসান এবং মুক্তির পথ নির্দেশ করে। এগুলো গৌতম বুদ্ধের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা যা বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি ও কাঠামো গঠন করে। এই সত্যগুলি অনুসরণ করে মনের প্রশান্তি ও প্রকৃত সুখ অর্জন সম্ভব হয়।
বৌদ্ধ ক্ষনভঙ্গবাদ বা ক্ষণিকত্ববাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিকত্ববাদ (Impermanence) বা ক্ষণভঙ্গবাদ হলো বৌদ্ধমতের অন্যতম মৌলিক তত্ত্ব যা বলে যে এই জগতের সবকিছুই অনিত্য, স্থায়ী নয়, বা ক্ষণস্থায়ী। অর্থাৎ, এই জগতে যা কিছু আছে তা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যায় এবং পুনরায় অন্য রূপে সৃষ্টি হয়। এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হল যে, কোনো বস্তু বা সত্তার আসল অস্তিত্ব তার কার্য উৎপাদনের ক্ষমতা (অর্থক্রিয়াকারিত্ব) দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেসব বস্তু কার্য করতে সক্ষম, তারা সৎ (আস্তিত্বশীল) এবং ক্ষণস্থায়ী, কারণ তাদের কার্যক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটে। বৌদ্ধ দার্শনিক রত্নকীর্তি এই ক্ষণিকত্ববাদের অন্বয়ব্যাপ্তি এবং ব্যতিরেকব্যাপ্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, অর্থাৎ কাজ করার ক্ষমতা যুক্ত বস্তু ক্ষণস্থায়ী; যা স্থায়ী নয়, তা কার্যকর নয়।
ক্ষণের মধ্যে বস্তুর অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু পরক্ষণেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়, এবং তার সদৃশ অন্য একটি বিনষ্ট বীজ বা সত্তায় রূপান্তরিত হয়। এই বীজ প্রবাহ (continuous becoming) ধারা অবিরাম চলতে থাকে, যার ফলে কোনো বস্তু বা আত্মা সম্পূর্ণ স্থায়ী হয় না। তাই বৌদ্ধ দর্শন বিশ্বাস করে আত্মা বা চেতনাও স্থায়ী নয়, বরং ক্ষণিক হিসাবে চলতে থাকে।
ক্ষণিকত্ববাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে বৌদ্ধ প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বের (Dependent Origination) উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা বলে যে সবকিছুই কারণ-পরিণামের নিয়মে সৃষ্টি হয়ে অঙ্গাসঙ্গ ভেঙে পড়ে। তাই কোনো কিছুই চিরন্তন বা পরিবর্তনহীন নয়। এই ক্ষণিকত্ববাদ বৌদ্ধ ধর্মের তিন লক্ষণ (Trilakshana)র একটি, যার মধ্যে অন্য দুটি হলো দুঃখ (বেদনা) এবং অনাত্মা (আত্মাহীনতা)।
সারসংক্ষেপে, বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদ বোধ করায় যে জগতের সবকিছুই চলমান, পরিবর্তনশীল, এবং ক্ষণস্থায়ী। এই উপলব্ধি মানুষকে আসক্তি ও আবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে গভীর বোধগম্যতা ও শান্তিতে পৌছায়। বৌদ্ধ ধ্যান ও আচার এই মৌলিক সত্যের গভীর উপলব্ধি এবং গ্রহণের মাধ্যমে জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখায়।
বৌদ্ধদের আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদ বা নৈরাত্মবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ ধর্মের আত্মা সম্পর্কীয় মূল মতবাদ হলো নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মবাদ (Anātman)। এই মতবাদ অনুসারে, স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় কোনো আত্মা বা স্বতন্ত্র "আমি" বা "আত্মা" নামক সত্ত্বা নেই। বৌদ্ধ দর্শনে আত্মার ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়, যে "আমি" বা "আত্মা" যা আমরা চিন্তা করি, তা আসলে কোনো স্থায়ী সত্তা নয়, বরং সরলভাবেই পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী।
বৌদ্ধমতে জীবনের সমস্ত অস্তিত্ব পঞ্চস্কन्ध (পাঁচ উপাদান) দ্বারা গঠিত, যা হলো - রূপ (দেহ), বেদনা ( অনুভূতি),সংজ্ঞা (পাল্পনা), সংস্কার (মানসিক সৃষ্টি), এবং বিজ্ঞান (চেতনা)। এই পাঁচটি উপাদান একত্রে সাময়িকভাবে একটি জীব থাকা বোঝায়, কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনো স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব নেই। প্রতিটি উপাদানই পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী এবং নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্যে থাকে।
অনুবাদের ভাষায় বলা যায়, বৌদ্ধ নৈরাত্মবাদ অনৈতিক বা আধ্যাত্মিক ভাবনায় স্থায়ী "আত্মা" বা "স্ব" ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং জীবনের অনিত্যতা, দুঃখ এবং অনাত্মতার অর্থ তুলে ধরে। এই দর্শনের উদ্দেশ্য হলো দুধকা (দুঃখ বা কষ্ট) থেকে মুক্তি পাওয়া, যা মূলত আমাদের ভুল ধারনা ও আসক্তি থেকে উদ্ভুত। বৌদ্ধমতে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করে, মূলত মায়া বা বিভ্রম থেকে মুক্তির পথ দেখানো হয়।
উল্লেখযোগ্য হল যে, বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে কিছু বিরোধ আছে যে প্রাথমিক বৌদ্ধ ধ্যানবাদে আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল না, আবার কিছু বৌদ্ধ ধ্যান ও পণ্ডিতেরা বলছেন যে প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী আত্মার ধারণাটা পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়নি। তবুও প্রধানত বৌদ্ধ দর্শনের মূলমন্ত্রই হলো "আত্মা নেই"—অর্থাৎ "অনাত্মা" বা "নৈরাত্ম্য"।
এই মতবাদ বৌদ্ধ ধর্মকে অন্যান্য ধর্ম যেমন হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা করে, যেখানে স্থায়ী আত্মা বা আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক অধিষ্ঠান হলো "প্রতীত্যসমুত্পাদ" অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু, জীব ও ঘটনা পারস্পরিক শর্ত ধরে উৎপন্ন হয় এবং স্থায়ী কোনো সত্ত্বা নেই, সবই পরিবর্তনশীল।
সারাংশে, বৌদ্ধদের আত্মা সম্পর্কীয় নৈরাত্মবাদ বলতে বোঝানো হয় যে, কোনো স্থায়ী বা সত্যিকারের আত্মা নেই, যা একটি প্রকৃত "আমি" হিসেবে কাজ করে। জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা, মন-মস্তিষ্ক ও শারীরিক উপাদান মিলিত হয় সময়ে সময়ে তারূপে পরিবর্তিত হয়, এবং এই পরিবর্তনশীলতাই জীবন ও দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথের মূলধন.
বৌদ্ধ দর্শনে দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: বৌদ্ধ দর্শনে দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র হলো জীবনের জন্ম-মরণ, দুঃখ, পুনর্জন্মের কারণ ও তা থেকে মুক্তির কার্য-কারণ শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এটি "প্রতীত্যসমুৎপাদ" বা নির্ভরশীল উৎপত্তির মতবাদ থেকে উদ্ভূত, যা বলে সবকিছু পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের কারণ। ভবচক্র মূলত বারোটি নিদান বা শৃঙ্খলা নিয়ে গঠিত, যা একে অপরের ফলে ঘটতে থাকে এবং জীবের দুঃখ ও অসন্তোষের চক্র হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে।
দ্বাদশ নিদানের তালিকা:
১. অবিদ্যা (অজ্ঞান বা মহাজ্ঞানহীনতা) – সমস্ত দুঃখের মূল কারণ
২. সংস্কার (কার্যকলাপ বা মনস্তাত্ত্বিক গঠন)
৩. চেতনা (বিজ্ঞান বা চিন্তার উদ্ভব)
৪. নামরূপ (নাম এবং রূপ, বা মানসিক ও দেহাত্মক অবস্থা)
৫. আয়তন বা ষড়ায়তন (ছয় ইন্দ্রিয়ের ভিত্তি)
৬. স্পর্শ (ইন্দ্রিয় সংস্পর্শ)
৭. বেদনা (অনুভূতি বা সুখ-দুঃখ)
৮. তৃষ্ণা (তৃষ্ণা বা বাসনা)
৯. উপাদান (বিশয়ানুরাগ বা আসক্তি)
১০. ভব (পুনর্জন্মের প্রবৃত্তি বা কর্মের প্রবণতা)
১১. জাতি (পুনর্জন্ম বা জন্ম)
১২. জরামরণ (বৃদ্ধ হওয়া ও মৃত্যুর দুঃখ)
এখানে প্রথম দুটি নিদান অতীত জীবনের সঙ্গে, পরবর্তী আটটি বর্তমান জীবনের সঙ্গে এবং শেষ দুটি নিদান ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা থেকে শুরু হয়ে এই নিদানগুলি জীবকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ রাখে। বৌদ্ধ দর্শনে এই চক্রকে 'ভবচক্র' বলা হয়, যা জীবনের চাকা বা অস্তিত্বের চক্রকে প্রতীকীভাবে দেখায়। এই চক্রের মধ্যে আটড়ে পড়েই জীব দুঃখভোগ করে, আবার বুদ্ধের শিক্ষায় দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখানো হয়.
ভবচক্রের প্রতীকী চিত্রে মৃত্যুর দেবতা যম দ্বারা চাকা ধরা হয়, যার কেন্দ্রে অবিদ্যা, সংযুক্তি ও ঘৃণার তিন বিষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রাণী থাকে। এই চক্রের বাইরের স্তর জীবন ও কর্মের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর ওপর চাঁদ সংসার থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে থাকে। বুদ্ধ ওই চাঁদের দিকে নির্দেশ করেন, যা মুক্তির পথযোগ্যতা বোঝায়.
সারাদিন, বৌদ্ধ দর্শনে দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র হলো দুঃখের উৎপত্তি ও অবসানের কারণ এবং নিয়ম যা জীবের পুনর্জন্ম এবং বন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য বোঝা প্রয়োজন। এটি বৌদ্ধ ধর্মের দ্বিতীয় আর্যসত্য (দুঃখের কারণ) হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাণ লাভে এই চক্র বুঝে ও ছিন্ন করা অপরিহার্য.
সুতরাং, বৌদ্ধ দর্শনে দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র জীবনের চিরস্থায়ী দুঃখ ও পুনর্জন্মের কারণ সমূহের বিশদভাবে বিশ্লেষণ, যা থেকে মুক্তি পেতে তাকে ছিন্ন করতে হবে বলে বুদ্ধশিক্ষা শেখায়। এটি বৌদ্ধ ধ্যান ও নফল অনুসন্ধানের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব।
জৈন স্যাদবাদ তথ্য সবিস্তারে আলোচনা কর।
অংশ: জৈন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদগুলোর মধ্যে গুরত্বপূর্ণ একটি হলো "স্যাদবাদ" বা "স্যাৎবাদ"। এটি মূলত জৈন যুক্তিবিদ্যার এক বিশেষ তত্ত্ব যা বস্তু বা সত্তার বহুমুখিতা ও আপেক্ষিকতা প্রকাশ করে। জৈন দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ও প্রকৃত জ্ঞান কোনো সসীম ও অবজ্ঞাত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রত্যেক বিবৃতি বা বিচারকে "স্যাৎ" অর্থাৎ "সম্ভবত বা শর্তসাপেক্ষ" ধরা উচিত।
স্যাদবাদের মূল ভাব ও বৈশিষ্ট্য
স্যাদবাদ মানে হলো "শর্তসাপেক্ষ সত্য" বা "কোনো বিষয় সব দিক থেকে একই সঙ্গে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না"। বস্তু বা ঘটনাগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হলে তাদের অনেক বৈশিষ্ট্য বা সত্য সামনে আসতে পারে। এসব মধ্যে কোনোটাই পূর্ণতায় একক বা একমাত্র সত্য নয়।
জৈন দর্শনে বলা হয় বস্তু বা সত্তার স্বরূপ বহুমুখী, "অন্তহীন গুণ-বৈশিষ্ট্য" সম্পন্ন, এ কারণে এক বা একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বস্তু ব্যাখ্যা করা যায়।
স্যাদবাদে সাতটি পরামর্শ বা বাক্যের ব্যবহার থাকে, যা "সপ্তভঙ্গি" নামে পরিচিত। এগুলি হলো বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষ সত্যের নমুনা, যা মিলিয়ে সত্যের বহুমুখী দিক প্রকাশ করে। যেমন—"স্যাৎ অস্তি" (সম্ভবত আছে), "স্যাৎ নাস্তি" (সম্ভবত নেই), "স্যাৎ অব্যক্তব্যম্" (সম্ভবত অবক্তব্য) ইত্যাদি।
স্যাদবাদকে সন্দেহবাদ (scepticism) বলা যায় না, কারণ সন্দেহবাদ জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ করে কিন্তু স্যাদবাদ জ্ঞানের সম্ভাবনার সত্যতায় বিশ্বাস রাখে।
দর্শন ও বিশ্লেষণ
জৈনমতে, জ্ঞান কিংবা সত্য স্থান, কাল ও দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভরশীল, তাই অভিজ্ঞান সবসময়ই আপেক্ষিক এবং শর্তসাপেক্ষ।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, "বস্তুবাদের" ধারক জৈন দর্শনে বস্তু বা সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব এবং তাদের গুণের স্বতন্ত্রতা মেনে নেওয়া হয়।
স্যাদবাদের মাধ্যমে জৈন দর্শন বস্তুর বিভিন্ন দিক ও বৈশিষ্ট্যের একত্রিত ও সহাবস্থান বুঝিয়ে দেয়, যা জৈন দর্শনকে পৃথিবীর বহুমুখী বাস্তবতার প্রযোজ্য করে তোলে।
সারাংশ
জৈন স্যাদবাদ হলো একটি দার্শনিক শর্তসাপেক্ষ সত্যের তত্ত্ব যা বলে বস্তু বা পরিস্থিতির প্রকৃত অর্থ বা সত্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় এবং প্রত্যেকটি দৃষ্টিভঙ্গিই শর্তসাপেক্ষ সত্য হতে পারে। এটি জৈন দর্শনের অনেকান্তবাদী মুক্ত চিন্তার প্রতিফলন, যেখানে পূর্ণ জ্ঞান শুধুমাত্র সর্বজ্ঞের পক্ষে সম্ভব এবং সাধারণ মানুষের জন্য আপেক্ষিক জ্ঞান লাভ সম্ভব। জৈন স্যাদবাদের এই দর্শন অনেকাংশে জৈন নীতিমালা ও তত্ত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়.
আপনি যদি চান, আমি সাতটি "সপ্তভঙ্গি" তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও উদাহরণও দিতে পারি।
ন্যায় মতে ব্যাপ্তি কি, ব্যাপ্তির স্বরূপ আলোচনা কর।
Ans: ন্যায় মতে ব্যাপ্তি হল হেতু ও সাধ্যের মধ্যে একটি নিয়ত, অব্যভিচারী ও উপাধিমুক্ত সহচার সম্পর্ক। সহজে বলতে গেলে, ব্যাপ্তি হলো এমন একটি সম্পর্ক যেখানে একটা বিষয় (হেতু) যখন উপস্থিত হয় তখন নির্দিষ্ট আরেকটি বিষয় (সাধ্য) অবশ্যই উপস্থিত থাকে, এবং হেতু না থাকলে সাধ্যও অনুপস্থিত থাকে। এটি অনুমানের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ব্যাপ্তি অর্থাৎ ব্যাপকতা বা বিস্তৃতি বলে যেখানে হেতু পদ দেখা যায় সেখানে সাধ্য পদও অবশ্যই দেখা যায় এমন অপরিবর্তনীয় সম্পর্ককে নির্দেশ করে। যেমন, "যেখানে ধূম আছে সেখানে অগ্নি আছে"—এটা ব্যাপ্তির উদাহরণ। এখানে ধূম হলো হেতু এবং অগ্নি হলো সাধ্য।
ব্যাপ্তির স্বরূপ বা প্রকৃতি:
ব্যাপ্তি “সহচার” এবং “নিয়ম”—এই দুইয়ের মিশ্রণ।
সহচার মানে সমানাধিকরণের মত একই অধিকরণে বা স্থলে দুই বিষয়ের একসঙ্গে থাকা।
নিয়ম অর্থ কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই ধ্রুব সত্য থাকা। অর্থাৎ যেখানে হেতু থাকে সেখানে অবশ্যই সাধ্য থাকে এবং তার ব্যতিক্রম নেই।
ব্যাপ্তি হল অনুমানের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত, কারণ অনুমানটি হেতু ও সাধ্যের মধ্যে এমন একটি অনন্তবল্টিত সম্পর্কের উপর নির্ভর করে যা সত্য ও স্থায়ী।
ব্যাপ্তির প্রকার:
১. সমব্যাপ্তি: যেখানে হেতু ও সাধ্যের বিস্তৃতি একসমান হয়, যেমন "যার উৎপত্তি আছে তার বিনাশও অবশ্যই আছে।"
২. অসমব্যাপ্তি বা বিষয়ব্যাপ্তি: দুইয়ের বিস্তৃতি সমান নয়।
সংক্ষেপে, ন্যায় মতে ব্যাপ্তি হ’ল অনুমানের একটি কাঠামো যা হেতু (কারণ) ও সাধ্য (কারণস্বরূপ বস্তু) মধ্যে অনুত্তরীয় সম্পর্ককে নির্দেশ করে, যা অনুমানের সত্যতা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পঞ্চ অবয়ব বা পঞ্চাবয়বী ন্যায় কাকে বলে? ভারতীয় ন্যায়ের সাথে অ্যারিস্টোটলের ন্যায়ের তুলনামূলক আলোচনা কর।
Ans: পঞ্চ অবয়ব বা পঞ্চাবয়বী ন্যায় বলতে বোঝায় ভারতীয় ন্যায় দর্শনের পরার্থানুমানের এক বিশেষ রূপ, যা পাঁচটি অংশ বা অবয়ব নিয়ে গঠিত। এই পাঁচটি অবয়ব হল—
প্রতিজ্ঞা (প্রস্থাব): যেখানে বক্তা বিষয়ে তার পক্ষে বা পক্ষের বক্তব্য রেখে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রকাশ করেন, যেমন "পর্বতটি বহ্নিমান"।
হেতু (লিঙ্গ): যা সাধ্যকে প্রমাণ করে বা সাধ্যের কারণ নির্দেশ করে, যেমন "পর্বতটি ধূমবান"।
উদাহরণ (দৃষ্টান্ত): যেখানে সাধ্যের এবং হেতুর মধ্যে সম্পর্ক বা ব্যাপ্তি দেখানো হয়, যেমন "যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি"।
উপনয়: যেখানে পক্ষটির উপর ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন "পর্বতটিও ধূমবান"।
নিগমন (উপসংহার): যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী অবয়বগুলির সম্মিলিত যুক্তিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়, যেমন "সুতরাং, পর্বতটি বহ্নিমান"।
অর্থাৎ, পঞ্চাবয়বী ন্যায় হলো একটি যৌক্তিক প্রমাণ পদ্ধতি যা পরার্থানুমানকে বিস্তারিতভাবে পাঁচটি উপাদানে ভাগ করে প্রতিষ্ঠা করে। এটি মূলত অন্যকে বোঝানোর জন্য যুক্তি প্রদান প্রক্রিয়া।
অ্যারিস্টোটলের ন্যায় বা সিলোজিজমের সাথে এর তুলনায় বলা যায় যে, ভারতীয় পঞ্চাবয়বী ন্যায়ের "উপনয়" অবয়বটি অ্যারিস্টোটলের "মাইনর প্রিমিস" বা লক্ষণীয় প্রিমিসের (minor premise) সাথে মিল রয়েছে। দুটোই যুক্তির একটি পর্যায় যা পক্ষের ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তবে ভারতীয় ন্যায় দর্শন পঞ্চাবয়বী কাঠামোর মাধ্যমে অনুমানের ধারাকে আরও বিশদভাবে ভাগ করে দেয়, যেখানে প্রতিটি অবয়ব যুক্তির একটি নির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করে। অন্যদিকে অ্যারিস্টোটলের সিলোজিজম সাধারণত তিনটি অংশে বিভক্ত: মেজর প্রিমিস, মাইনর প্রিমিস, এবং কনক্লুশন। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনে অনুমান বা যুক্তি কর্তনের পাঁচটি অংশ থাকলেও, পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যায় এটি তিন ভাগে সীমাবদ্ধ।
সারাংশে, ভারতীয় পঞ্চাবয়বী ন্যায় একটি কারণে বিস্তৃত এবং বিশ্লেষণাত্মক ধাঁচে যুক্তির উপাদানগুলি ব্যাখ্যা করে, যেখানে পশ্চিমা অ্যারিস্টোটলিয়ান সিলোজিজম তুলনামূলকভাবে সংক্ষেপে যুক্তির কাঠামো তুলে ধরে। দুটির লক্ষ্য একটি— যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, তবে পদ্ধতিগত ভিন্নতা বিদ্যমান।
বৈশেষিক দর্শনে বিশেষের ধারণা আলোচনা কর।
Ans: বৈশেষিক দর্শনে "বিশেষ" শব্দের ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্ব যা পদার্থের পৃথকত্ব এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাস্তবতার শ্রেণীবিভাজন করে। বৈশেষিক দর্শন প্রধানত মহর্ষি কণাদের প্রতিষ্ঠিত, যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে প্রাচীন ভারতের একটি প্রাচীন দার্শনিক প্রবণতা।
বৈশেষিক দর্শনের মতে, বাস্তবতাকে বিভিন্ন "পদার্থ" বা বস্তু হিসাবে বোঝা হয় যেগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভেদ এবং স্বতন্ত্রতা বিদ্যমান। এই পার্থক্য এবং স্বতন্ত্রতাকে বোঝানোর জন্য "বিশেষ" বা "বিশেষত্ব" (Vishesha) ধারণাটি ব্যবহৃত হয়। বিশেষ হলো সেই চরম ভেদক শক্তি, যা কোনো পদার্থকে অন্য পদার্থ থেকে পৃথক করে তোলে এবং নিজেও অন্য বিশেষ থেকে পৃথক হয়। সহজভাবে বলা যায়, এটি কোনো বস্তু বা পদার্থের অনন্য বৈশিষ্ট্য যা তাকে অন্য থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।
বৈশেষিক দর্শনে নিত্যদ্রব্য (অবিনাশী ও অংশহীন সরল পদার্থ) যেমন: পৃথিবী, জল, বায়ু, তেজ, আকাশ, দিক, কাল, আত্মা, মন ইত্যাদিতে "বিশেষ" পদার্থ সর্বদাই থাকে। কারণ এই নিত্যদ্রব্যগুলি অন্যের থেকে আলাদা করতে শুধুমাত্র গুণ, ক্রিয়া, জাতি বা অবয়ব দ্বারা পার্থক্য করা যায় না; তাদের পার্থক্যের জন্য অন্তত একটি বিশেষ বা ভেদক শক্তি বাধ্যতামূলক। বিশেষ নিজেই চরম ব্যাবর্তক, যার কোনো অন্য ব্যাবর্তক নেই, অর্থাৎ এটি স্বতা ব্যাবর্তক।
উদাহরণস্বরূপ, একটি লাল রঙের বস্তু অন্য একটি লাল রঙের বস্তু থেকে "বিশেষ" দ্বারা ভিন্ন হতে পারে যদিও গুণ বা জাতি একই হতে পারে। এছাড়া, দুটি সমান রকমের পরমাণু বা অংশহীন বস্তু যাদের গুণাবলী একই, তাদের পৃথক করতে বিশেষের ধারণা প্রয়োজন।
বিশেষ হলো বস্তুকে প্রকৃত অর্থে পৃথক ও স্বতন্ত্র করে তোলা এবং তাতেই বৈশেষিক দর্শনের মূল উদ্দেশ্য—বাস্তবতাকে স্বতন্ত্র ও নির্বিশেষভাবে জানতে চাওয়া। তাই বৈশেষিক দর্শনকে "বিশেষ" (ভেদক ধর্ম) ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এটি দর্শনে একটি কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে।
সংক্ষেপে, বৈশেষিক দর্শনে "বিশেষ" হলো সেই চরম ব্যাবর্তক বা পার্থক্যকারী গুণ যা একটি পদার্থকে অন্য পদার্থ থেকে ভিন্ন ও পৃথক করে তোলে এবং এই কারণেই বৈশেষিক দর্শনের দর্শনশাস্ত্রে বিশেষের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ ধারণার মাধ্যমে বস্তুবিশ্বের পার্থক্য, স্বাতন্ত্র্য, ও ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়।
এটি বৈশেষিক দর্শনের বাস্তবতাবাদের কেন্দ্রীয় ধারণা যা অভিজ্ঞতা ও যুক্তির মাধ্যমে জ্ঞানের ভিত্তি প্রদান করে।
জৈন দর্শনের দ্রব্য তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
Ans: জৈন দর্শনের দ্রব্য তত্ত্ব (Shad Dravya) অনুযায়ী, মহাবিশ্ব ছয়টি শাশ্বত এবং অক্ষয় মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। এই ছয়টি দ্রব্য হল:
জীব (আত্মা) - সংবেদনশীল, চেতনা সম্পন্ন সত্তা, যা অনন্ত ও অক্ষয়।
পুদ্গল (অজীব পদার্থ) - অচেতন পদার্থ বা বস্তু, যেটি পরমাণুর সমষ্টি।
ধর্ম - গতির নীতি, যা বস্তু ও প্রাণীর গতি বা চালিকা শক্তি।
অধর্ম - বিশ্রামের নীতি, যা গতির বিপরীত, বস্তু ও প্রাণীর বিশ্রামের কারণ।
আকাশ (স্থান) - মহাশূন্য, যা বস্তু ও প্রাণীর অবস্থান নির্ধারণ করে।
কাল (সময়) - সময়, যা পরিবর্তন এবং ক্রমের সূচক।
এই ছয়টি দ্রব্য একসঙ্গে মহাবিশ্বের বাস্তবতা গঠন করে এবং অমর ও চিরন্তন হিসেবে বিবেচিত। জীব ও পুদ্গল জীবিত ও অজীব বস্তুর মধ্যে প্রধান ভেদ নির্দেশ করে, বাকি চারটি (ধর্ম, অধর্ম, আকাশ, কাল) অজীব দ্রব্য নামে পরিচিত। এই তত্ত্বে দ্রব্যকে মহাবিশ্বের নিত্য ও অপরিবর্তনীয় মূল উপাদান হিসেবে ধরা হয়, যেখানে পদার্থের পরিবর্তন শুধু পর্যায়গত, দ্রব্যের নষ্ট হওয়া বা উৎপত্তি হয় না।
অতিরিক্তভাবে, জৈন দর্শনে দ্রব্যের সংজ্ঞা হলো — "উৎপত্তি, ধ্বংস এবং স্থিতিশীলতাসম্পন্ন সত্তা," অর্থাৎ যে কোনো বস্তু যার উৎপত্তি ও ক্ষয় হয় এবং যা কোনও সময় স্থির থাকে তাই দ্রব্য।
সুতরাং, জৈন দর্শনের দ্রব্য তত্ত্ব মহাবিশ্বের মৌলিক গঠন এবং বস্তুর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য বোঝাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক কাঠামো।
ধর্ম কয় প্রকার ও কি কি।
Ans: ধর্ম সাধারণত মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস, আচরণ এবং উপাসনার একটি ব্যবস্থা। ধর্ম বিভিন্ন প্রকারের এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। মূলত ধর্ম তিন প্রকারে ভাগ করা হয়ে থাকে:
বিশ্বধর্ম (Universal religions): এ ধরনের ধর্মের লক্ষ্য পৃথিবীব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা অর্জন এবং সক্রিয়ভাবে নতুন অনুসারী গ্রহণ করা। উদাহরণ স্বরূপ খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্ম, বাহাই ধর্ম ইত্যাদি।
জাতিগত ধর্ম (Ethnic religions): এই ধর্মগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জাতি বা সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কিত হয় এবং নতুন ধর্মান্তরিতদের গ্রহণ করে না। যেমন ইহুদি ধর্ম।
নতুন ধর্মীয় আন্দোলন (New religious movements): সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত ধর্মসমূহ এই ক্যাটাগরিতে পড়ে।
এছাড়াও ভারতীয় দর্শন অনুসারে ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকার রয়েছে যেমন সামন্যধর্ম, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম, গুণধর্ম, নিমিত্তধর্ম, অপধর্ম ইত্যাদি, যা ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, জীবনের পর্যায় ও গুণ অনুযায়ী শ্রেণীবদ্ধ।
বিশ্বে বর্তমান আনুমানিক ৪৩০০টিরও বেশি ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, তবে প্রধান ধর্ম হিসাবে চারটি ধর্মের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে: খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম। এই চার ধর্মের অনুসারী মোট বিশ্বের ৭৭% মানুষ.
সুতরাং ধর্মের প্রধান প্রকারগুলি হলো:
বিশ্বধর্ম
জাতিগত ধর্ম
নতুন ধর্মীয় আন্দোলন
আর ভারতীয় দৃষ্টিতে ধর্মের ভেতরে বিভিন্ন প্রকার ভয়েসমিল রয়েছে, যেমন সামন্যধর্ম, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম ইত্যাদি.
আশা করি এই তথ্য আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে।
কেবল জ্ঞান কি।
Ans: কেবল জ্ঞান হলো জৈন ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার অর্থ সর্বজ্ঞতা বা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা। এটি এমন একটি জ্ঞান যা সম্পূর্ণ উপলব্ধি বা মহাবিশ্বের সর্বাঙ্গীন বোধগম্যতা নির্দেশ করে। জৈন দর্শনে কেবল জ্ঞান হল আত্মার অন্তর্নিহিত গুণ, যা আত্মাকে ঘিরে থাকা কর্ম কণিকার ক্ষয়ে অর্জিত হয়। কেবল জ্ঞান অর্জনের পর সেই আত্মাকে "কেবলিন" বলা হয়, যিনি সকল দিক থেকে এবং সমস্ত রূপে বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারেন। এই কেবল জ্ঞান অর্জন জৈন সাধুদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
জৈনধর্মে কেবল জ্ঞান পাওয়ার জন্য একাধিক স্তর অতিক্রম করতে হয় এবং সর্বশেষ কেবলিন ছিলেন মহাবীর তীর্থংকরসহ তার শিষ্যগণ। দিগম্বর এবং শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের মধ্যে কেবলিনদের স্বভাব এবং আচরণের বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে।
সংক্ষেপে, কেবল জ্ঞান হল সেই অতিমানবীয় জ্ঞান যা আত্মার মুক্তি এবং সর্বোচ্চ উপলব্ধির অবস্থাকে বোঝায়, যা জৈন ধর্মের তত্ত্ব ও সাধনার মূল লক্ষ্য।
সাত কথার দ্বারা কি বুঝানো হয়।
Ans: "সাত কথা" বলতে সাধারণভাবে বোঝায় ‘সাতটি বাক্য’ বা ‘সাতটি লাইন’‑এর কবিতা।
বাংলা সাহিত্যে বা কবিতায় সাত কথা বলতে এমন একটি স্বল্প আয়ের কবিতা বা রচনাধারা বোঝানো হয়, যেখানে সম্পূর্ণ ভাবনা মাত্র সাতটি বাক্য বা পঙক্তিতে প্রকাশ করা হয়।
তবে কিছু ক্ষেত্রে ‘সাত কথা’ কথাটি বিশেষ সাহিত্যধারা বা লোকজ প্রবাদার্থেও ব্যবহৃত হয়—যেমন:
কবিতা বা ছড়ার গঠন – চীনা কবিতার সাত অক্ষরের পদ (七言詩 – সাত-অক্ষরের পদ্য) থেকে প্রভাবিত হয়ে বাংলা বা আধুনিক কাব্যে ‘সাত কথার’ ছন্দের ব্যবহার।
প্রবাদগত অর্থ – সংক্ষিপ্ত অথচ সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশের প্রতীক।
ধর্মীয় প্রেক্ষাপট – কিছু খ্রিস্টীয় গ্রন্থে ‘যিশুর সাত কথা’ বলতে ক্রুশে বিদ্ধ অবস্থায় যিশুর উচ্চারিত সাতটি উক্তি বোঝানো হয়।
আপনি যদি আমাকে বলেন, আপনি কোন প্রসঙ্গে "সাত কথা" বলতে চাচ্ছেন — সাহিত্যিক, প্রবাদমূলক নাকি ধর্মীয় — তাহলে আমি আপনাকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞা ও উদাহরণ দিতে পারি।
আপনি কি সাহিত্য প্রসঙ্গের "সাত কথা" জানতে চাচ্ছেন?
আর্য সভ্য কি চারটি আর্য সভ্য কি কি।
Ans: "আর্য সভ্যতা" বলতে সাধারণত প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে বৈদিক যুগের সভ্যতাকে বোঝানো হয়, যা আর্য জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর্যরা মূলত মধ্য এশিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আগত ইন্দো-ইরানীয় গোষ্ঠী ছিল, যারা ভাষা, ধর্ম এবং সামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। আর্য সভ্যতা ধ্যান, সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম এবং সাহিত্যিক ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য ও বেদের সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত।
আর্য সভ্যতার চারটি প্রধান শ্রেণী বা সমাজবর্গ ছিল:
ব্রাহ্মণ (৮গুরূ, পুরোহিত এবং ধর্মশিক্ষক)
ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা ও শাসক)
বৈশ্য (ব্যবসায়ী ও কৃষক)
শূদ্র (পরিষেবা ও কাজ কর্মে নিযুক্ত লোক)
এগুলি ছিল আর্য সমাজের মূল শ্রেণীবিন্যাস এবং এই আচার ও সামাজিক কাঠামো বৈদিক সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে, "চারটি আর্য সত্য" বা "চার আর্য সভ্যতা" বলতে বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষাগুলো বোঝায়, যা গৌতম বুদ্ধ প্রাচীন ভারতের মানুষের দুঃখ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে প্রদান করেছিলেন। চারটি আর্য সত্য হল:
দুঃখ আছে (জীবন দুঃখপূর্ণ)
দুঃখের কারণ আছে (বাসনা বা তৃষ্ণা দুঃখের মূল কারণ)
দুঃখের নিরোধ আছে (দুঃখ থেকে মুক্তি সম্ভব)
দুঃখ নিরোধের পথ আছে (অষ্টাঙ্গিক মার্গ - আটটি পথ যা দুঃখ থেকে মুক্তির নির্দেশ দেয়)
সুতরাং, আর্য সভ্যতা বলতে আমরা প্রাচীন ভারতের বৈদিক আর্যদের সমাজ ও সভ্যতাকেই বুঝি, আর চারটি আর্য সত্য হল বৌদ্ধ ধর্মের মূল দর্শন.
বুদ্ধদেবের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ আর্য সত্য কি।
Ans: গৌতম বুদ্ধের প্রধান উপদেশ ও শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হলো "চতুরার্য সত্য" বা চারটি আর্য সত্য। এগুলি হলো জীবনের প্রকৃত দুঃখ এবং সেই দুঃখ থেকে মুক্তির পথের মূল ভিত্তি। বুদ্ধদেব এই চারটি সত্যকে মানুষের জীবনের মৌলিক বাস্তবতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই চারটি সত্য হলো:
প্রথম আর্য সত্য: দুঃখ সত্য
জীবনে দুঃখ বা কষ্ট অবশ্যম্ভাবী; জন্ম, বয়স, অসুস্থতা, মৃত্যু, অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা—all এগুলোই দুঃখ। এই দুঃখ মানে জীবনের অসন্তোষজনক প্রকৃতি।
দ্বিতীয় আর্য সত্য: দুঃখ সমুদয় সত্য
দুঃখের মূল কারণ হলো তৃষ্ণা বা বাসনা। আমাদের অভিলাষ, প্রলোভন, আসক্তি ও ভালোলাগা পৃথিবীর বন্ধনে বেঁধে দেয় এবং সেগুলো থেকেই দুঃখ জন্মায়। অবিদ্যা বা অজ্ঞতাও দুঃখের একটি মূল কারণ।
তৃতীয় আর্য সত্য: দুঃখ নিরোধ সত্য
দুঃখ নিরোধ বা দুঃখের অবসান সম্ভব। যখন আমরা তৃষ্ণা ও বাসনা ও অবিদ্যা দূর করতে পারি, তখন দুঃখের অবসান ঘটে এবং নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়।
চতুর্থ আর্য সত্য: দুঃখ নিবৃত্তির পথ সত্য
দুঃখ নিরোধের জন্য একটি পথ আছে, যাকে বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটগুণ পথ বলেছেন। এই পথের মাধ্যমে মানুষ দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারে। অষ্টাঙ্গিক মার্গে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক ক্রিয়া, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।
এগুলি মিলিয়ে বুদ্ধদেবের চতুরার্য সত্য প্রদর্শন করে মানব জীবনের বাস্তব দুঃখ, তার কারণ, সমাধান এবং সেই সমাধানে পৌঁছানোর নির্দিষ্ট পথ.
দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র কাকে বলে।
Ans: দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র হলো বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা জীবনের চক্র এবং পুনর্জন্মের কারণ ও প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে। এটি বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের মূল কারণ ও পুনর্জন্মের কারণে স্থিতিশীল এক আবর্তন যা অবিদ্যা থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে দুঃখ ও জন্মের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
"দ্বাদশ নিদান" অর্থাৎ বারোটি কারণ বা শৃঙ্খলা, যা একে অপরের উপর নির্ভরশীলভাবে জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু ও পুনর্জন্ম পর্যন্ত চালিত হয়। এই বারোটি নিদানের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মে কর্ম এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র (সংশ্লেষে "ভবচক্র") বোঝানো হয় যা অবিদ্যা (অজ্ঞতা) থেকে শুরু করে তৃষ্ণা (আসক্তি), এবং পুনর্জন্ম পর্যন্ত নিয়ে যায়।
এভাবে, ভবচক্র বা দ্বাদশ নিদান মানে হলো এক ধরনের "জীবনের চাকা" বা "পুনর্জন্মের চক্র," যা বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের দুঃখ, জম্ম ও পুনর্জন্মের অবিরাম চক্রের প্রতীকী চিত্রসমূহ। এটি কর্মফল অনুযায়ী জীবনের পুনর্জন্মের নিয়ম ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি লাভের পথ বর্ণনা করে।
সংক্ষেপে:
ভবচক্র বা দ্বাদশ নিদান বারোটি শর্ত বা কারণের শৃঙ্খলা যা জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে পুনর্জন্ম পর্যন্ত চলমান দুঃখময় চক্র বোঝায়।
এই চক্রের মূল উৎস হলো অবিদ্যা (অজ্ঞতা) যা জীবকে এই পৃথিবীতে দুঃখের মাঝে আবদ্ধ রাখে।
বৌদ্ধ ধর্মে মুক্তি বা নির্বাণ লাভের মাধ্যমে এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এটি বৌদ্ধ দর্শনের একটি মৌলিক শিক্ষার অংশ যা জীবনের অস্তিত্ব ও পুনর্জন্মের কারণ এবং মুক্তির পথ ব্যাখ্যা করে।
ত্রিপিটক কাকে বলে।
Ans: ত্রিপিটক হলো বৌদ্ধধর্মের প্রধান পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যার অর্থ তিনটি পিটক বা তিনটি ঝুড়ি। এটি গৌতম বুদ্ধের ধর্ম, দর্শন এবং বাণী সম্বলিত সংগ্রহ, যা তিনটি ভাগে বিভক্ত — বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক। পিটক শব্দটি পালি ভাষায় ঝুড়ি বা বাক্স অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেখানে ধর্মীয় গ্রন্থ সংরক্ষণ করা হয়।
ত্রিপিটক গ্রন্থের রচনা গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পর শুরু হয়ে প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৩ থেকে ২৩৬ খ্রিস্টপূর্ব অবধি তিনটি মহাসঙ্ঘায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন প্রায় ২২০০ অরহৎ ভিক্ষু।
তিনটি পিটকের মূল বিষয় হলো:
বিনয় পিটক: ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের নৈতিক নিয়মাবলী ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধান।
সূত্র পিটক: বুদ্ধের ধর্মোপদেশ ও বাণী সংকলিত অংশ।
অভিধর্ম পিটক: বৌদ্ধ দর্শন ও তত্ত্বের বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা।
ত্রিপিটক পালি ভাষায় রচিত এবং থেরবাদী বৌদ্ধদের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য।
জৈন মতে জিনকি।
Ans: জৈন মতে, "জিনকি" বলতে বোঝানো হয় একজন মহাকৃচ্ছ্র সাধক যিনি ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছেন এবং সম্পূর্ণ মুক্তি বা মোক্ষ লাভের পথে অগ্রসর হয়েছেন। জৈন ধর্মে জিন বা জিনকি হল সেই তীর্থঙ্কররা যারা আত্মার মুক্তি ও সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জন করেছেন। তারা ইন্দ্রিয় বিজয়ী, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন ব্যক্তিরাই জিন বা জিনকি হিসেবে পরিচিত। জৈন ধর্মের প্রধান লক্ষ্য মোক্ষ বা মুক্তি অর্জন, যার জন্য সৎ জীবন ও কৃচ্ছ্র সাধনা অপরিহার্য।
সংক্ষিপ্তভাবে:
জৈন মতে জিন বা জিনকি হল অঅপরাজেয় সাধক, যে ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে অধিষ্ঠিত।
তারা মুক্তির পথে চলেন এবং সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন।
এই জিন বা জিনকিরাই তীর্থঙ্কর বা বৃহত্তর আধ্যাত্মিক শিক্ষকেরূপে পূজিত হন।
পঞ্চ স্কন্ধ কি।
Ans: পঞ্চ স্কন্ধ (বা পঞ্চ খন্ধ) বৌদ্ধ দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার অর্থ হলো পাঁচটি সমষ্টি বা অংশ যেগুলো দ্বারা জীবন্ত সত্তার অস্তিত্ব গঠিত হয়। এই পাঁচটি স্কন্ধ হলো:
রূপ (দেহরূপ বা বস্তুর রূপ),
বেদনা (সুখ-দুঃখের অনুভূতি),
সংজ্ঞা (ধারণা বা চিন্তার উপাদান),
সংস্কার (মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, ক্রিয়া বা অভ্যাস),
বিজ্ঞান (চেতন বা সচেতনতা)।
এই পাঁচটি স্কন্ধ একত্রে জীবনের সকল দেহ-মন সম্পর্কিত উপাদান বোঝায় এবং বৌদ্ধ দর্শনে তৃষ্ণা ও আঁকড়ে থাকার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জীবনের দুঃখ ও বেদনার উৎস হিসেবে এই পঞ্চ স্কন্ধকে দেখা হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মে এসব থেকে মুক্তি পাওয়াই মুক্তির পথ।
অর্থাৎ, পঞ্চ স্কন্ধ হলো জীবন্ত সত্তার পঞ্চ উপাদান বা সমষ্টি, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্ত উপাদানের সমষ্টি এবং যেগুলোর আঁকড়ে ধরে বা শনাক্ত হওয়ার ফলে বুদ্ধের মতে দুঃখ ও শোক সৃষ্টি হয়। এই ধারণা বৌদ্ধ দর্শনের মূল তত্ত্বের অন্তর্গত।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: "পঞ্চ স্কন্ধ" নামটি বেদব্যবস্থায় বা অন্য ধর্মীয় প্রসঙ্গেও ব্যবহার হতে পারে, কিন্তু এখানে বৌদ্ধ দর্শনের পক্ষে ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো। এছাড়া "পঞ্চম স্কন্ধ" নামে শ্রীমদ্ভাগবতের এক অংশও আছে যা ভিন্ন ধারার বিষয়।
সংক্ষেপে, পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয় জীবনের পাঁচটি মৌলিক উপাদান বা দেহ-মন সমষ্টিকে, যা জীবন ও অস্তিত্বের গঠন করে এবং বৌদ্ধ ধর্মে এসব থেকে বিরতি বা নির্বাণ লাভের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত।
পঞ্চশীল কি।
Ans: পঞ্চশীল হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ যেন লাই কর্তৃক ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি নীতি, যা ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে পাঁচটি মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এগুলি হলো:
পরস্পরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা
পরস্পরের প্রতি আক্রমণ না করার চুক্তি (অ-আগ্রাসন)
গার্হস্থ্য বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরস্পরের হস্তক্ষেপ না করা (অ-হস্তক্ষেপ)
সমতা এবং পারস্পরিক স্বার্থবোধ
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
এই পাঁচটি নীতি মিলেমিশে পঞ্চশীল নীতির নামে পরিচিত, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়।
অন্য অর্থে, বৌদ্ধধর্মে পঞ্চশীল বা পঞ্চ উপদেশ বলতে বৌদ্ধ ধর্মীয় নৈতিকতার পাঁচটি মৌলিক নিয়মকেও বোঝানো হয়, যা ব্যক্তিগত আচার-আচরণের জন্য প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে প্রতি শ্রদ্ধিত হয়ে থাকে।
আপনার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে পঞ্চশীল বলতে মূলত ভারত-চীন মৈত্রী চুক্তির পাঁচটি নীতিকে বুঝানো হয়।
নির্বাক কাকে বলে।
Ans: "নির্বাক" বলতে বোঝায় যে ব্যক্তি কথা বলে না বা যার মুখে কোনো কথা নেই।
বাংলায় "নির্বাক" শব্দের অর্থ:
শব্দগত অর্থ: "নি" (বিহীন) + "বাক" (কথা) = যে কথা বলে না, বাকহীন।
প্রচলিত ভাষায় অর্থ:
যে ব্যক্তি স্বভাবত বা পরিস্থিতি অনুযায়ী চুপ করে থাকে।
বিস্ময়, দুঃখ, রাগ বা অন্য কোনো কারণে মুহূর্তের জন্য কথা হারিয়ে ফেলা।
জন্মগতভাবে বা অসুস্থতার কারণে কথা বলতে অক্ষম ব্যক্তি।
উদাহরণ বাক্য:
দুর্ঘটনার খবর শুনে সে নির্বাক হয়ে গেল।
ছোটবেলা থেকে সে নির্বাক, কথা বলতে পারে না।
আপনি কি চান আমি "নির্বাক" শব্দের প্রতিশব্দ ও বিপরীত শব্দও বলি?
মোক্ষ বা মুক্তি কি।
Ans: মোক্ষ বা মুক্তি হলো আত্মার পুনর্জন্ম বা জীবন-মৃত্যুর চক্র (সংসার) থেকে মুক্তির অবস্থা, যা দুঃখ, বেদনা ও অজ্ঞানতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে স্থায়ী শান্তি, আনন্দ ও পরম সত্যরূপ অভিজ্ঞতার অবস্থা। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
মোক্ষের অর্থ সাধারণত আত্মার মুক্তি, যা জীবনের বিভিন্ন বন্ধন যেমন কামনা, বেদনাদায়ক অবস্থা, মায়া ও অজ্ঞানতা থেকে মুক্তির প্রতীক। এ অবস্থায় ব্যক্তি নানান শাস্ত্রীয় জ্ঞান, ধ্যান, এবং সত্যের উপলব্ধির মাধ্যমে জীবনের মায়াজাল থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। হিন্দুধর্মে মোক্ষ জীবনের চার পুরুষার্থের (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) মধ্যে সর্বোচ্চ পুরুষার্থ।
জীবন্মুক্তি বলতে জীবদ্দশায় এই মোক্ষ লাভের অবস্থা বোঝায় যেখানে ব্যক্তি পৃথিবীর বন্ধন থেকে মানসিক ও আত্মিকভাবে মুক্ত থাকে, আর মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ মোক্ষ (বিদেহ মুক্তি) লাভ হয়।
সংক্ষেপে, মোক্ষ বা মুক্তি হলো জীবন-মৃত্যুর পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্ত হয়ে স্থায়ী চিরন্তন শান্তি, সত্তার প্রকৃত রূপ উপলব্ধি করা।
আপনি চাইলে মোক্ষের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা এর বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন।
🌸 অবশ্যই সবাইকে শেয়ার করে। 👁️🗨️